অপমানিত হওয়ার আগেই সাবধান হোন

আমি একটা বেসরকারি কোম্পানীতে চাকরি করি। মূলত বলা যায় সেলস ম্যান। খুলেই বলি। আমি একটা নামকরা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীতে মেডিকেল ইনফরমেশন অফিসার হিসেবে কাজ করছি। আমাদের কাজ হচ্ছে ডাক্তারকে নিয়মিত ভিজিট করা অর্থাৎ নতুন/পুরাতন প্রোডাক্ট এর ইনফরমেশন দেয়া আর ফার্মেসীগুলো থেকে অর্ডার নেয়া। আমি সবসময় সম্মানের সাথে কাজ করেছি, কখনো অপমানিত হবো এমন ভয় মনের মধ্যে আসেনি কারন আমি আমার দিক থেকে সৎ ছিলাম।

সকাল নয়’টায় কাজ শুরু করি, দুপুর ১ টা কিংবা ১ টা বেজে ৩০ মিনিটে কাজ শেষ করি। আবার বিকেল ৫ টায় বের হই আর ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা কিংবা ১১টা বা তারও পরে। ঘরের বউ তো নাছোরবান্দা। সে রাত ১০ টা বাজলেই “কখন আসবা” বলে এসএমএস করতে থাকে।

তো এগুলো মোটামুটি পেরেশানির চাকরি। ধৈর্য্য না থাকলে এ চাকরি করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের উপরের লেভেলের নাম হলো ম্যানেজার অর্থাৎ এরিয়া ম্যানেজার। অন্তত ৫ বা ৬ বছর পরে পরীক্ষার মাধ্যমে ম্যানেজার হওয়া যায়। ম্যানেজার হলে চাপ আগের চেয়ে বেড়ে যায়। শুধু অর্ডার কাটা আর ডাক্তার ভিজিট থেকে সামান্য রেহাই পাওয়া যায়।

এখন আসল কথায় আসি। আমি যে কোম্পানীতে চাকরি করি এখানে মূলত শুধু গিফ্ট দেয়, কোন ওষুধের স্যাম্পল আমাদের নেই। মাসের শুরুতে আমাদের কাছে কয়েক কার্টুন গিফ্ট আসে। আবার মাসের মাঝখানে ম্যানেজারের কাছে কিছু গিফ্ট আসে (আমাদেরকে দেয়ার জন্য)। ম্যানেজারের কাছে আসা গিফ্টগুলো বেশ এক্সক্লুসিভ।

ম্যানেজারের আন্ডারে আমরা সাত জন কলিগ। এটা ২০২৪ সালের কথা। আমি যে এলাকায় চাকরি করতাম সেখানে ঐ বছর রাস্তা-ঘাটের কাজ শুরু হয়। অর্থাৎ রাস্তা ঘাটের সংস্কার শুরু হয়। ছোট বড় সব রাস্তা কেটে ফেলে। হাটার মতোও রাস্তা নেই, গাড়ি চালানো তো দূরের কথা। সেই বছর আমাদের সেলস টার্গেট করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমি ৭০ থেকে ৮০% সেলস করতাম। বাকি সবারও প্রায় একই অবস্থা। এ ব্যাপারে ম্যানেজার খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। উনার কথা, যেভাবেই হোক – আপনারা আমাকে বাজেট করে দেন। কিন্তু এটা আসলে অসম্ভব ছিলো।

আমরা সেলস টার্গেট পূরণ করতে পারছিলাম না বলে ম্যানেজার আমাদেরকে কোন গিফ্ট দিতো না (তার কাছে যা আসতে সেগুলো থেকে)। অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিনি তেমন কোন এক্সক্লুসিভ গিফ্ট আমাদের দেয়নি। চাইলেও আমরা নিতে পারিনি। উনি ওসব গিফ্ট কি করতো তা একমাত্র আল্লাহই জানে। তবে আমরা বিভিন্ন ধরণের আইডিয়া করতে পারি, আপনারাও করতে পারেন।

এভাবেই চলছিল। আমরা টিমের ৭ জনের কেউ-ই মুখ খুলে কোন কিছু বলতাম না। আপনাদের জানিয়ে রাখি, ম্যানেজারের উপরের পোস্ট হলো জোনাল হেড এবং তার উপরের পোস্ট হলো সেলস ম্যানেজার। আমাদের সেলস ম্যানেজার ঐ বছর পরিবর্তন হয়েছিলো। আমাদের নতুন সেলস ম্যানেজার আগের সেলস ম্যানেজার এর তুলনায় খুবই স্মার্ট ছিলেন – এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি এখানে জয়েন করেই বলেছিলেন যে, কোন ম্যানেজার কোন গিফ্ট কার্টুন নিজের রুমে যাতে না রাখে অর্থাৎ সব গিফ্ট যেন কলিগদের ঠিক মতো ভাগাভাগি করে দিয়ে দেয়।

কে শোনে কার কথা! হয়তো কয়েকজন ম্যানেজার স্যার এর কথা মনোযোগ সহকারে শুনেছিল এবং তাই করেছিল কিন্তু কিছু ম্যানেজার আগের অভ্যাসেই অভ্যস্ত রইলো যেখানে ১ নম্বর সাড়িতে ছিল আমার ম্যানেজার সাহেব। এসব বলতেও আমি অপমানিত বোধ করছি।

হঠাৎ কিছুদিন পরে সেলস ম্যানেজার স্যারের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দেখা যায় যে, তিনি পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত। সেলস ম্যানেজার স্যার এতে খুবই মর্মাহত হলেন এবং ভেঙে পড়লেন। ইন্ডিয়া গিয়ে চিকিৎসা করালেন। এই পোস্ট যখন লিখছি তখন তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আবার ইন্ডিয়া গিয়েছেন অপারেশন করানোর জন্য। এ ব্যাপারে হয়তো পরে আপডেট দিতে পারবো।

এখন মূল কথায় আসি অর্থাৎ আমার ম্যানেজার সাহেব কতোটা অসহায়ভাবে অপমানিত হলেন। প্রত্যেক মাসের শুরুর দিকে আমাদের মান্থলি মিটিং হয়। আর তিন মাস পর পর বাইরের কোন অভিজাত হোটেলে কোয়ার্টারলী মিটিং হয়। জুলাই মাসের শুরুতেই আমরা মিটিং করার উদ্দেশ্যে অফিসে গেলাম। মিটিং শুরু হলো সকাল ৯ টায়, শেষ কয়টায় হবে তা আমাদের অজানা। কারন, আমাদের কাজের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। শুরুর সময় ১ মিনিট লেট হলেও আপনাকে হয়তো কথা শুনতে হতে পারে কিন্তু রাত ২ টা পর্যন্তও যদি মার্কেটে থাকেন, কাজ করেন কেউ আপনাকে বলবে না যে – আপনি বাসায় চলে যান। কেউ খোঁজ নেবে না – আপনি এখনও মার্কেটে আছেন। ফার্মাসিউটিক্যালস চাকরি বেশ জটিল ও কঠিন চাকরি।

এদিকে অফিসের এক সহকারী এসএম স্যারের বাসায় বিভিন্ন কাজের উদ্দেশ্যে নিয়মিত যাতায়াত করতো। সে আবার জানতো যে, ম্যানেজার আমাদের কোন গিফ্ট দেয় না। সে এই ব্যাপারটি এসএম স্যারের কানে দিয়েছে। এসএম স্যারকে সবকিছু খুলে বলেছে। আমরা লজ্জায় স্যারকে কিছু বলতে পারি না – এক কথাও সে বলেছে।

তখন বাজে ১২ টা। ম্যানেজার আমাদের সাথে রুমে আছে। হঠাৎ এসএম স্যার আমাদের রুমে আসলেন। রুমের মধ্যে থাকা গিফ্ট এর কার্টুনগুলো দেখে রাগান্বিত হয়ে বললেন যে -“এসব কার? এগুলো এখনো কেন পড়ে আছে এখানে? গত মাসের গিফ্ট এখনও কেন পড়ে আছে?”

আরও অনেক কিছু বলেছেন। ম্যানেজার তো মাথা নিচু করে কোন কিছু বলতেই পারছে না। তার কোন জবাব নেই। আর আমরা ৭ কলিগ তো হাসি আটকিয়ে রাখতে পারছি না। ভেতর থেকে হাসি পাচ্ছিল। যাই হোক, আমি কন্ট্রোল করেছিলাম।

আসলে লিখে তো আর ঐ পরিস্থিতি আপনাদের বোঝানো সম্ভব নয়। ম্যানেজার সেদিন কি পরিমাণ যে অপমানিত হয়েছিলেন তা কেবল আল্লাহই জানে। উনি কিছু বলতেই পারছিলেন না। একটা মাস নয় – টানা ৬ টা মাস উনি কোন গিফ্ট আমাদের দেয়নি। এসব ধীরে ধীরে উনার বাসায় গিয়ে যেতেন আর হয়তো কিছু রেখে দিতেন আর কিছু বিক্রি করে দিতেন।

এসএম স্যার কার্টুনগুলো কাটার সময়ও ম্যানেজারকে দেননি। আমাদেরকে কার্টুন কাটতে বাধ্য করেছেন উনি। রুমের সাথেই ওয়ারশরুমে অনেক এক্সক্লুসিভ গিফ্ট ম্যানেজার রেখে দিয়েছেন। এসএম স্যার যদি সেই বিষয়টা জানতো তাহলে আরও যে কি হতো! ম্যানেজার আরও যে কতোটা অপমানিত হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরে সমস্ত গিফ্ট আমরা ভাগাভাগি করে নিলাম। ম্যানেজার লজ্জায় আসলে কথা বলতে পারছিলেন না। হয়তো উনার ঘুম কিছু দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিল। আমি মনে করি, ম্যানেজার অপমানিত হওয়ার মাধ্যমে তার কর্মফল ভোগ করেছেন।

প্রকৃতি বলতে একটা কথা আছে। আর আমি বিশ্বাস করি – এই সমস্ত প্রকৃতিই মহাজ্ঞানী আল্লাহতায়ালা’ই নিয়ন্ত্রণ করেন। আপনি কি করছেন তা আর কেউ না জানলেও আল্লাহ কিন্তু ঠিকই জানে। তাই অপমানিত হওয়ার আগেই সাবধান হোন। কর্ম যেমন ফল তেমনই হবে – আজ নয়তো কাল। কথায় আছে না – চোরের সাত দিন, গৃহস্থের একদিন। আপনি চুরি করছেন মানে একদিন না একদিন আপনি ধরা পড়বেন-ই।

একজন ম্যানেজার বেতন পান প্রায় ১ লাখ টাকা। ছোট কোম্পানীগুলোতে অবশ্য এতো বেতন দেয়া হয় না। তবে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা প্রায় সব কোম্পানী-ই দেয়। এরপরেও স্যাম্পল, গিফ্ট, ভাউচার ইত্যাদি কেন বিক্রি করতে হবে? কেন চুরি করে নিজের জন্য নিতে হবে। নিজের জন্য নেয়ার তো অপশন আছে। কেন সব নিতে হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই। আর তা হলো মানুষ সুযোগ পেলে তার লোভ সামলাতে পারে না। যখন সামনে সুযোগ চলে আসে তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।

আমার ম্যানেজার যেভাবে অপমানিত হয়েছে – উনার যদি লজ্জা-শরম থাকে তাহলে আর কোনদিন এমন কাজ করবে না। আর আবারও যদি একই কাজ করেন তাহলে হয়তো তাকে ট্রান্সফার নিতে হবে নয়তো চাকরিটাই নাই হয়ে যাবে।

পরিশেষে আমি বলতে চাই, আসুন না আমরা সবাই মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি। সৎ পথে থেকে সৎ উপার্জন করি। কেউ কারও শত্রু না হই, কেউ কারোটা মেরে না খাই। তাহলেই জীবন সুন্দর। সুখী হওয়ার জন্য চুরি করতে হয় না। অল্পে তুষ্টি থাকলেই যথেষ্ট। অপমানিত হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু মানুষ তো ভুল করতেই পারে। এই ভুল যেন বার বার না হয়। সুস্থভাবে বেঁচে থেকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত পরিবারের সাথে খেতে পারলেই আমার মনে হয় জীবন সুন্দর, কোনদিন অপমানিতও হতে হবে না ইনশাআল্লাহ! মনে রাখবেন, সম্মান রক্ষা করার মালিক আল্লাহ।

আরও পড়ুন: ঢাকা শহর রঙিন কিন্তু জীবন রঙিন নয়

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top