সাধারন নাগরিকের ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে কতটুকু জানা প্রয়োজন

আমরা এখন যে যুগে বাস করছি সেই যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে জানাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট সেবা এখন ঘরে ঘরে পৌছে গেছে। সুতরাং আমরা যদি এর ব্যবহার সম্পর্কে না জানি তবে আমরা পিছিয়ে থাকবো।

এখন, যারা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট নিয়ে পড়াশোনা করছে তাদের হিসাবটা আলাদা। তারা তো এর ব্যবহার সম্পর্কে জানছেই। কিন্তু যারা সাধারন নাগরিক তাদের আসলে কতটুকু জানা প্রয়োজন? আমার এই লিখায় মূলত সেটাই আমি প্রকাশ করবো।

বাংলাদেশের কথা যদি এখন চিন্তা করি তাহলে বলা যায়, বাংলাদেশের বহু মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রায় ঘরে ঘরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন। এখন যাদের ঘরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন তারা যদি এই ফোনটার ব্যবহারই না জানে তাহলে এই ফোন কিনে কি লাভ হলো!

অন্তত ফোনটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে কারও সাথে ভিডিও কলে কথা বলা যায়, কিভাবে ইন্টারনেটে কোন কিছু সার্চ করে বের করতে হয় এসব বিষয় জানা প্রয়োজন।

ছোট্ট একটা ঘটনা শেয়ার করি। আমি আমার স্ত্রীসহ ঢাকায় বাস করি। ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানীতে আমি চাকরি করি। কিছুদিন আগে হঠাৎ আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার প্রস্রাবে সমস্যা হচ্ছিল। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, বার বার প্রস্রাব হওয়া, চুলকানি হওয়া, মাথা ব্যথা, ভালো না লাগা, রুচি না থাকা সহ আরো বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল।

আমি বাজার থেকে বেশ কিছু ওষুধ কেমিষ্টদের সাথে কথা বলে এনে সেবন করিয়েছিলাম। কিন্তু উপকার তেমন হলো না। পরে একজন ডাক্তার দেখালাম। উনি কিছু টেস্ট দিলেন আর বললেন যে, এই টেস্টগুলো অবশ্যই করতে হবে। দ্রুত টেস্টগুলো করিয়ে আনুন।

আমার স্ত্রীর এই লক্ষণগুলো নিয়ে আমি ইন্টারনেটে সার্চ করেছি। তারপর নিজে নিজেই বুঝতে পেরেছি যে, এটা তার মূত্রনালীর সংক্রমণ হয়েছে। এই সমস্যা বার বার হলে কিডনীতে প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। আবার চিকিৎসা দ্রুত না করালেও সমস্যা হবে।

সেই সময় আবার আমি যে এলাকায় থাকি সেখানে রাস্তা-ঘাটের কাজ চলছিল। রাস্তার মাঝখানে খুড়ে বড় বড় পাইপ বসাচ্ছিল পানি নিষ্কাশনের জন্য। সেই জন্য রাস্তা দিয়ে চলাচল ছিল দুরূহ ব্যাপার। আবার ছিল বর্ষাকাল। সবমিলে পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল। আমি যে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভালো কোন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে (যেমন পপুলার, ইবনেসিনা, ল্যাবএইড ইত্যাদি) যাবো সেটাও সম্ভব হচ্ছিল না। পরে আমি অন্য চিন্তা করলাম।

আমি জানতাম যে, অনলাইনেও ল্যাব টেস্ট করা যায়। বিশেষ করে ডকটাইম, আরোগ্য, মেড-ইজি সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে আরোগ্য নামক অ্যাপটা ইন্সটল করা ছিল। সেই অ্যাপটির ভিতরে ঢুকে দেখলাম যে, তারা স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে গিয়ে পপুলার এর প্রধান সেন্টার সেখান থেকে টেস্ট করায়। আমার স্ত্রী পপুলার থেকেই টেস্ট করাতে চাচ্ছিল। পরে আমি অনলাইনে টেস্ট করানোর জন্য অর্ডার দিলাম।

আমি যদি ইন্টারনেট এই ব্যবহারটা না জানতাম, তাহলে নিশ্চয়ই আমি এভাবে অর্ডার করতে পারতাম না। তো দেখুন, আমি অর্ডার করেছি সকাল ১১ টায়। আর আরোগ্য থেকে একজন ল্যাব টেকনোলোজিস্ট দুপুর ৩ টার মধ্যে আমার বাসায় চলে এসেছে। রাস্তা-ঘাট এতো ভাঙা হওয়া স্বত্বেও তিনি সময় মতো চলে এসেছেন। ব্যাপারটা সত্যিই আমাকে অবাক করেছে।

তারপর উনি স্যাম্পল নিয়ে চলে গেলেন। সেদিন রাত ১১ টার মধ্যে আমাকে তারা রিপোর্ট দিয়েছে। আমি তো ভাবছিলাম, পরের দিন ছাড়া রিপোর্ট পাবো না। তারপর রিপোর্টগুলো হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে কয়েকজন ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিলাম। আর আমাকে পরামর্শ দেবার জন্য অনুরোধ করলাম।

অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েকজন ডাক্তার রেসপন্স করলেন এবং আমাকে ওষুধ সাজেস্ট করলেন। আমি সেদিনই ওই ওষুধগুলো নিয়ে আসলাম এবং সেগুলো ৭ দিন আমার স্ত্রী নিয়মিত সেবন করার ফলে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

এই ঘটনা থেকে কি বুঝলেন? আমি আমার অ্যান্ড্রুয়েড ফোনটাকে কতটুকু কাজে লাগালাম ভেবে দেখুন তো। যে কাজ করতে আমার অনেক টাকা খরচ করতে হতো, কায়িক পরিশ্রম করতে হতো, আমার স্ত্রীর কষ্ট হতো – সেই কাজ আমি মোবাইলের কয়েকটা বাটন টিপেই করে ফেললাম। ব্যাপারটা সত্যিই ভাবার।

আমার দেখা অনেকেই আইফোন ব্যবহার করে অথচ তারা এভাবে যে অনলাইনে সেবা পাওয়া যায় সেটা জানে না। তাদের ফোনেও তো প্লে স্টোর রয়েছে। তারা কখনো সেই স্টোরে গিয়ে ঘাটাঘাটি করে না। বরং কারও কাছ থেকে ইমো, কারও কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার এগুলো অ্যাপ শেয়ারিং এর মাধ্যমে নেয়। কতটুকু বোকা হলে মানুষ এভাবে কাজ করে। আমি বোকা বললাম এই জন্যেই যে, ওই অ্যাপগুলো চালাতেও তো তার ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে।

সুতরাং হে পাবলিক! আপনারা ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হোন। মোবাইলের সঠিক ব্যবহার জানুন। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো শিখুন। নিজে নিজে সার্চ করে শিখুন।

ইউটিউবের নাম জানে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। ইউটিউব হচ্ছে ভিডিও দেখার প্লাটফর্ম। এখানে প্রায় সবরকম ভিডিও-ই আপনি পাবেন। বিভিন্ন হাতের কাজ, টিউটোরিয়াল, পড়াশোনা সংক্রান্ত অর্থাৎ আপনি কি চান তার সবই পাবেন। শুধু মাত্র আপনাকে সার্চ করে বের করতে হবে। এই সার্চ করার কাজটা অতটা জটিল কিন্তু নয়। নিজে নিজে একটু চেষ্টা করলেই পেরে যাবেন।

এমনও লোক আছে যে, সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকে। তাকে যদি অন্য আরেকটি ফোন দিয়ে বলা হয়, এই ফোনে আপনার ফেসবুক আইডিটি সার্চ করে বের করে দিন সে পারবে না। কারন সে এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবে নি। কিন্তু ব্যাপারটি খুবই সহজ।

যদিও পারে কিভাবে পারে বলছি। তার মূল নাম লিখে ফেসবুকে হয়তো সার্চ দেবে। কিন্তু মূল নামে তো বহু মানুষ থাকতে পারে। তাই তার আইডিটি সামনে আসতেও পারে আবার নাও আসতে পারে। কিন্তু সে যদি তার ইউজার নেইম দিয়ে সার্চ করে তাহলে শুধু মাত্র তার ফেসবুক আইডিটি শো করবে। কিন্তু ঐ পাবলিক তো ইউজার নেইম কি সেটাই জানে না। আমার ফেসবুক ইউজার নেইম হলো “azgar.korotoya”. এটা দিয়ে ফেসবুকের সার্চ অপশনে যদি সার্চ করা হয় তবে কেবল আমার প্রোফাইল চলে আসবে, আর কারোটা নয়।

এখন সাধারন মোবাইল ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে কতটুকু জানা প্রয়োজন তা তুলে ধরছি।

সাধারন ব্যবহারকারীদের আসলে খুব বেশি জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ব্যাসিকটা অন্তত জানতে হবে। যেমন:

১. মোবাইলে কারও নাম্বার সেভ করা ও খুঁজে বের করা জানতে হবে। এটা দরকারি একটা বিষয়।

২. ইমেইল অ্যাপ (জিমেইল) সম্পর্কে জানতে হবে। কেউ ইমেইল পাঠালে যেন বের করতে পারে। আবার কাউকে যেন ইমেইল পাঠাতে পারে সেটাও জানা উচিত।

৩. একটি ফোন বাজার থেকে কেনার পরে সঠিকভাবে চালু করার ব্যাপারটি যেন জানে। এটাও দরকারি। ফোন শাট ডাউন বা রিস্টার্ট দেয়া জানা জরুরী।

৪. ফোনের মধ্যে সিম কার্ড, মেমোরী কার্ড লাগানো এবং কিভাবে খোলে তা জানা প্রয়োজন।

৫. প্লে স্টোর আপডেট করা, সেখানে অ্যাকাউন্ট খোলা, অ্যাপ ডাউনলোড করা এবং সার্চ করে বিভিন্ন দরকারি অ্যাপ বের করা জানা প্রয়োজন। কোন অ্যাপ ডাউনলোড করার পরে সেটা যেন ব্যবহার করতে পারে, প্রয়োজনে যেন জিমেইল দিয়ে একাউন্ট খুলতে পারে তা জানা প্রয়োজন।

৬. মোবাইল ফোনের সেটিংস সম্পর্কে টুকিটাকি জানা প্রয়োজন। একদম ভেতরের সেটিংসগুলো সম্পর্কে জানতে হবে না।

৭. সঠিকভাবে ফেইসবুক ব্যবহার জানা প্রয়োজন। শুধু ফেইসবুক নয়, যতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

৮. বাচ্চাদের হাতে ফোন থাকলে তাহলে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে যে, তারা কোন খারাপ কিছুর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে কিনা! এটা একটা উদ্বেগের বিষয়। কারন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের অভিভাবক এসব ব্যাপারে উদাসীন – মোট কথা তারা জানেই না। এই বিষয়টি সঠিকভাবে অবশ্যই মনিটরিং করতে হবে।

৯. মোবাইলে রেকর্ডিং করা, ভিডিও রেকর্ডিং করা, ছবি তোলা এসব ব্যাপারে জানতে হবে। ব্যক্তি জীবনে এসব বিষয় কাজে লাগবে। পিডিএফ ফাইল সম্পর্কে জানতে হবে।

১০. লাস্ট অপশন হিসেবে বলবো, গুগলে যেকোন ব্যাপারে সার্চ করে তথ্য বের করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাহলে জীবনের যেকোন সময় বিষয়টি উপকারে আসবে। কেউ কিডনি নষ্ট হওয়ার কারন যদি জানতে চায় তাহলে www.google.com এ গিয়ে যদি ‘কিডনি নষ্ট হওয়ার কারন’ কিংবা ‘কিডনি নষ্ট’ যাস্ট এইটুকু লিখে সার্চ দেয় তাহলে তার সামনে হাজার হাজার ওয়েবসাইট চলে আসবে। সেখানে সে এই ব্যাপারে যেকোন ওয়েবসাইটে গিয়ে পড়তে পারবে। এই যুগে গুগলে সার্চ করার বিষয়টি জানতেই হবে। তবে সবকিছুই যেন ভালো হয়। আমি খারাপ কোন কিছু সার্চ করার ব্যাপারে বলিনি।

পরিশেষে বলা যায়, সাধারন মোবাইল ব্যবহারকারীদের উপরের বিষয়বস্তু অবশ্যই জানা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপনারা যদি এটা নিয়ে জরিপ করেন – উপরের বিষয়গুলো সাধারন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১০%-ও হয়তো জানে না। এটা মর্মাহত হওয়ার মতো বিষয়। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মানুষ একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকতেই ব্যস্ত থাকে। অন্যের গীবত গাওয়া খুব পছন্দ করে। নিজেরা কিছু শিখতে চায় না। জানতেও চায় না। আমি সচেতন নাগরিক তথা সবাইকে অনুরোধ করবো, প্রযুক্তিকে কাজে লাগান। আপনার পরিশ্রম কমে যাবে, কষ্ট কমে যাবে। জীবন সহজ হবে। জীবনে ভালো জায়গায় যাওয়ার রাস্তাটা সহজ হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: এক অস্থির জেনারেশন তৈরী করছি আমরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top