আমরা মানুষ এবং মৃত্যুর পরে আমাদের আরেকটি জীবন রয়েছে। সেই জীবনের কোন শেষ নেই। কিন্তু পৃথিবীতে আমরা এমন কিছু বিষয় রেখে যাই যার জন্য মৃত্যুর পরেও হয়তো আফসোস করতে হয়। এরকম অনেক বিষয় রয়েছে। আজ বাস্তবে ঘটে যাওয়া একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো আপনাদের সাথে। এই ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে।
আসলে আফসোসের বিষয়টি উহ্য। মৃত্যুর পরে আফসোস করার সুযোগ থাকবে কিনা সেটা একমাত্র আল্লাহই জানে। আমি এ ব্যাপারে সত্যিই জানি না। তবে বড় বড় বিজ্ঞ মাওলানা/মুফতি সাহেবগণ হয়তো এ ব্যাপারে ব্যাখা দিতে পারবেন। কিন্তু উহ্য রেখেই বিষয়টি প্রকাশ করতে চাই।
আমি তখন ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানীতে চাকরি করি। আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি সেই বাসার ঘটনা এটা। বাসাটি চার তলা। আমি থাকতাম নিচ তলায়। একটি রুম সাথে এটাচ বাথরুম। গাড়ি রাখার জায়গা আছে। আমার মার্কেটের মধ্যখানে বাসাটি ছিল তাই এদিক থেকে প্রেফার করতাম।
বাসার মালিকের বয়স বেশ অর্থাৎ ৭০ ছুই ছুই। আর উনার স্ত্রীর বয়স অনেকটা কম বলা যায় ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে হবে। উনাদের দুইটি মাত্র ছেলে। এক ছেলে পড়াশোনা করে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেছে, সেখানেই থাকে। আর আরেক ছেলে দেশেই এ বাড়িতেই থাকে। কোথায় যেন পড়াশোনা করে।
বাসায় যে ছেলেটা থাকে অর্থাৎ ছোট ছেলেটা বেশ মোটা সোটা টাইপের। কথা কম বলে। মা-বাবার তেমন যত্ন নেয় না বললেই চলে। আমার সাথে মাঝে-মধ্যে হাই হ্যালো হতো। এক বর্ষার দিনে এই ছেলেকে আমি আমার মোটরসাইকেলে করে ৪ কিলোমিটার রাস্তা এগিয়ে দিয়ে আসছিলাম। সেই থেকে সম্পর্ক আরকি।
আর বাসা মালিক অর্থাৎ আংকেল বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম ছিল। তখন অবসরপ্রাপ্ত ছিল। তিনিও খুব কম কথা বলতেন। কম মানে একেবারেই কম। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তরটি ছাড়া আর কিছুই বলতেন না। একটু মনমরা টাইপের ছিলেন। আশপাশের মানুষের সাথেও তেমন মিশতেন না। প্রায় সময় বাসায়-ই থাকতেন আর মাঝে-মধ্যে একটু বাজারে হেঁটে আসতেন।
আর আন্টি ছিলেন বদমেজাজি। বাসায় যেদিন প্রথম উঠি সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, উনি বদমেজাজী। বাসার সমস্ত দায়িত্ব উনার। উনাকে ছাড়া বাসায় কিছুই হয় না। অর্থাৎ বাসার প্রধান কর্তা তিনি। আমি খুব একটা কথা বলতাম না। আমার ভালো লাগতো না। উচিত জবাব দিলে ঝগড়া লাগবে, তাই আমি ঝগড়া করতে চাইনি। আমরা আমাদের মতো থাকতাম।
এভাবে প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে। আমিও বাসা চেঞ্জ করিনি। আমার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না আর তাই বাসা চেঞ্জ এর মতো সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারিনি। তখন আয় ছিল সীমাবদ্ধ আর ব্যয় ছিলো বেশি। বাসায় কিছু টাকা পয়সা প্রতি মাসেই দিতাম। মার্কেটে কিছু খরচ হতো। এটা সেটা মিলে মাস শেষে আমার হাতে কোন টাকাই থাকতো না।
২০২৪ সালের বড় ঈদের সময়কার কথা। তখন ছোট ঈদে বাসা থেকে ঘুরে এসেছি আর তাই বড় ঈদে যাইনি। প্রায় সব ভাড়াটিয়া চলে গেছে। নিচতলায় আমরা আর চারতলায় একটি নতুন ফ্যামিলি আর বাসা মালিক’রা ছিলাম। ঈদের একদিন পরে বাসা মালিক আংকেলকে একা বাসায় রেখে আন্টি আর উনার ছোট ছেলে ঘুরতে চলে গেছে। সম্ভবত সাজেক।
আমি কিংবা আমার স্ত্রী এসব ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। ঈদের দিন নামাজ পড়ে এসেই আমি জ্বরে আক্রান্ত হই। অনেক বেশি জ্বর ছিল। চিকিৎসা সেবা ও আল্লাহর রহমতে পরের দিন সামান্য সুস্থ হই। সেদিন রাত দশটায় আন্টি আমাকে ফোন দিয়েছে। বলতেছে, আংকেলের সাথে নাকি যোগাযোগ হচ্ছে না। একটু খোঁজ নিয়ে জানাতে বললো।
আমি তখন খোঁজ নেয়ার জন্য গেলাম। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরে আংকেল দরজা খুললেন। আমি উনাকে দেখেই তো অবাক। প্রচন্ড জ্বর, ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, পরনের লুঙ্গিটা নষ্ট হয়ে গেছে। সেদিন আবার সকাল থেকে আমার স্ত্রী আর মেয়ের জ্বর। তাদের অবশ্য আমার মতো এতো জ্বর আসেনি কিন্তু বেশ ছিল।
তখন আংকেল এর অবস্থার কথা আন্টিকে জানালাম। আন্টিকে দ্রুত গাড়িতে উঠতে বললাম। আমি তখন জানতাম না যে, আন্টি কোথায় ছিল। আন্টি আমাকে একবারের জন্যও বলেনি। তখন আন্টি বললেন যে, পরেরদিন রাতে তিনি গাড়িতে উঠতে পারবেন; তার আগে তিনি আসতে পারছেন না। কথাটা শুনে আমি বড় হতবাক হয়েছিলাম।
তারপর আর কি করার! আমি তো আংকেলকে ঐ অবস্থায় রেখে চলে আসতে পারিনা যদিও আমি অসুস্থ ছিলাম। তখন শুরুতেই আংকেলের মাথায় পানি ঢাললাম। পুরো শরীর মুছে দিলাম। লুঙ্গিটা চেঞ্জ করে দিলাম। তারপর আমার স্ত্রীকে বললাম জাও রান্না করতে। সে রান্না করে নিয়ে আসলে আংকেলকে আমি নিজ হাতে খাওয়াইলাম। কারন, নিজের হাতে খাওয়ার মতো শক্তি আংকেল এর শরীরে ছিলো না।
বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় ওটিসি ওষুধগুলো নিয়ে আসলাম। ওষুধগুলো খাওয়াইলাম। চার তলায় যে ফ্যামিলিটা থাকে তারাও একটু আধটু সহযোগিতা করেছে। ঐ ফ্যামিলিতে একটা ভাই সিঙ্গেল থাকতো। আমার চেয়ে বয়সে বেশ ছোট। তাকে অনুরোধ করলাম আংকেলের সাথে রাতটা থাকার জন্য। কারন, রাত্রে কোন প্রয়োজনে আংকেল একা উঠতে পারবে না। আর তাছাড়া এমন অসুস্থ মানুষকে একা রাখা ঠিকও হবে না।
ওই ভাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলো এবং আলাদা বিছানায় সারারাত ছিল। পরেরদিন সকালে আংকেলের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। আমি সারাদিন কাজ-কর্ম করে এসে আবার রাত্রে গিয়ে আগের দিনের মতো সব কাজ করে দিলাম। আবার চার তলার ওই ভাইটাকে রেখে আসলাম। পরেরদিন ভোরবেলা আন্টি আর আন্টির ছেলে বাসায় আসলেন।
তারা এসে বাসা পরিষ্কার করলেন। আংকেল এর যেটুকু যত্ন না করলেই নয় সেটুকু করলেন। আংকেল সেদিনও বেশ অসুস্থ ছিলেন। যেহেতু আন্টি বাসায় আসছেন আমি আর সেদিন যাইনি। তবে খোঁজ নিয়েছি। উনারা আংকেলকে সেদিন আর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি। তেমন কোন ওষুধও খাওয়াননি। পরিবারের সবাই নাকি ওষুধ খাওয়াতে অনীহা প্রকাশ করেন। আংকেল নিজেও। যাই হোক, এটা আমার কাছে ভালো দিক কিন্তু অসুস্থ হলে তো ওষুধ খাওয়া উচিত।
পরের দিন ছিল শুক্রবার। সেদিন বিকেল বেলা আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। কারন, বাচ্চাটারও জ্বর ছিল। তখন আংকেলের ছেলে আংকেলকে নিয়ে আমাদের সাথে ডাক্তারের কাছে গেলো। পুরো রাস্তা আংকেল একা হেঁটে গেছে। অথচ আংকেলের হাতটা সবসময়ের জন্য ধরে রাখা দরকার ছিলো। কারন, তখন রাস্তার কাজ চলছিল। রাস্তা খুড়া ছিল। এখানে সেখানে খাল, ইট, পাথর ইত্যাদি ছিল। হঠাৎ যদি আংকেল পড়ে যেতো তাহলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যেত।
যাই হোক, ডাক্তারের সাথেও আংকেল তেমন একটা কথা বলেনি। ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট দিয়েছিলেন আর অবস্থা বেশ খারাপ সে কথাও বলেছিলেন। তারপর তারা ওষুধ কিনে বাসায় চলে আসলেন। আমার সাথে আর দেখা হয়নি সেদিন। তবে আংকেলকে বেশ বিষন্ন মনে হয়েছিল সেদিন।
পরের দিন সকাল ১১ টায় আন্টি আমাকে ফোন করে বললো আংকেলের নাকি শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমি তখন ঐ ডাক্তারকে ফোন করতে বললাম যে ডাক্তারকে দেখানো হয়েছিল। ডাক্তার নেবুলাইজার দিতে বলেছিলেন। আন্টি আর নেবুলাইজার দেয়নি।
বিকেলে আংকেল বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখনও তারা আংকেলকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। সন্ধ্যার পরে গুরুতর অসুস্থ হলে পড়লে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। বাসা থেকে সামান্য দূরে গিয়েই আংকেল বমি করে। নিঃশ্বাস নিতে বোধ হয় খুব কষ্ট হচ্ছিল আর তিনি হাটতে পারছিলেন না। আমিও তখন মোটরসাইকেলে করে বাসায় আসছিলাম।
আমি ব্রেক হলাম আর আংকেলকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বিভাগে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার শুরুতেই প্রেসার চেক করলেন। প্রেসার অনেক বেশি ছিল। সম্ভবত ২০০/১৩০ হয়েছিল। এটা তো একেবারেই ইমার্জেন্সী। যেকোন মুহূর্তে স্ট্রোক হতে পারে।
পরে আন্টি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো যে, আংকেলকে মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাবে। আমি এম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে দিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে আংকেলকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলাম। সাথে ছিল আন্টি আর তাদের ছোট ছেলে। আমাকেও সাথে যেতে বলেছিল কিন্তু মার্কেট ইস্যুতে আমি সাথে যেতে পারিনি।
পরে বার বার খোঁজ নিচ্ছিলাম। আন্টি বার বার বলতেছে যে, আমি গেলে নাকি ভালো হতো। আমি মার্কেট থেকে রাত ১০ টায় বাসায় ফিরলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি যে, আমি যাবো আর সকালে ফিরে আসবো। আন্টি যেহেতু এতো করে বলতেছে। আর আমারও খারাপ লাগছে যে, আমার যাওয়া উচিত ছিল।
পরে আমি আন্টিকে বার বার ফোন দিচ্ছি এই কারনে যে, আমি আসতেছি এই কথা বলবো। কিন্তু উনি ফোন ধরছিলেন না। প্রায় ১৫ মিনিট পরে কল ব্যাক করলেন আর বললেন যে, তোমার আংকেল আর নেই। আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম। মানুষ এভাবে হঠাৎ মারা যায়! আমি তো কল্পনাও করিনি যে, আংকেল আজ মারা যাবে। যাই হোক, কি আর করার। মৃত্যুর মতো নিশ্চিত বিষয়কে না মেনে নেয়ার তো কোন উপায় নেই। কিছু কারনে আমারও যেন আফসোস এর শেষ নেই।
পরে আন্টি আংকেলকে নিয়ে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ওখানেই মাটি দেয়া হবে। ওখানেই আংকেলের দেশের বাড়ি। ব্যথিত মনে বলতে হচ্ছে যে, আমি আংকেলকে মাটি দিতে যেতে পারিনি। সিরাজগঞ্জ থেকে আন্টি আর উনার ছেলে প্রায় ১৫ দিনের মাথায় এ বাসায় এসেছে।
এখন মূল কথায় আসি। হেডলাইনে বলেছিলাম, মৃত্যুর পরেও কিছু বিষয় নিয়ে মানুষকে হয়তো আফসোস করতে হবে। আমি আপাতত আংকেলকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছি। আমি আংকেলের ছোট ছেলেকে কোনদিন মসজিদে যেতে দেখিনি। এমনকি আংকেল মারা যাওয়ার পরেও দেখিনি। আর আমার মনে হয়না, আন্টি নামাজ পড়ে। বিষয়টি নিয়ে সত্যিই আফসোস করতে হয়।
আন্টি তার বাসায় একটি স্কুল পরিচালনা করে যেখানে ছোট ছোট বাচ্চারা পড়াশোনা করে। আংকেল মারা যাওয়ার ২৩ দিনের মাথায় স্কুলটিতে আন্টি ডিজে গান বাজায়। আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। এটা কিভাবে সম্ভব? এই ২৩ দিনের মাথায়-ই উনি স্বাভাবিক হয়ে গেলেন! সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গেলেন! মানুষ এরকমও হয়।
তাহলে আংকেলের আফসোস করা ছাড়া আর কি রইলো। সন্তান আর স্ত্রী যদি আংকেল এর জন্য দোয়া না করে বরং এমন কাজ করে যার জন্য আংকেলের আত্মার কষ্ট হয় তাহলে এদের জন্য আংকেলের আফসোস করা ছাড়া আর কি রইলো! আশা করি, ধৈর্য্য ধরে যারা এই লিখা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই বুঝেছেন। আমি যদি পুরো বিষয়টি শেয়ার না করতাম তাহলে অনেক প্রশ্ন থেকে যেত।
মানুষ যখন মারা যায় তখন সে তো আর কিছু নিয়ে যেতে পারে না। সবকিছু দুনিয়াতেই পড়ে থাকে যা তার স্ত্রী-সন্তানেরা ভোগ করে। তাহলে মৃত মানুষটির জন্য ইসলামে যেটুকু নিয়ম রয়েছে সেটুকু মানতেও আমাদের এতো কষ্ট! জীবিত থাকাকালীন-ই এই আন্টি আংকেলকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আর এখন মারা যাওয়ার পরেও কষ্ট পাচ্ছে। তাহলে তার জীবনের আর কি বাকি রইলো।
তাই আসুন, আমরা আমাদের স্ত্রী-সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেই। বিশেষ করে ইসলামিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আমি মারা গেলে আমার স্ত্রী-সন্তান নামাজ না পড়ুক অন্তত এমন কাজ যেন না করে যার জন্য আমার আফসোস করতে হয়। নামাজ পড়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে ভুল বুঝবেন না। এখানে নামাজ পড়ার বিষয়টিকে আমি তুচ্ছ করিনি। কথার কথা বলেছি।
২৩ দিনেই যে নারী তার স্বামীর শোক ভুলে যায় সে যে আসলে কেমন নারী তা হয়তো আপনাদের বোঝার বাকি নেই। যাই হোক, সবাই এই আংকেলের জন্য দোয়া করবেন। আংকেলের নাম ছিল মো. ইসমাইল হোসেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুক (আমিন)।
আরও পড়ুন: অপমানিত হওয়ার আগেই সাবধান হোন