মো. আজগর আলীর জীবন ইতিহাস

আমি মো. আজগর আলী। আমার একটি ডাক নাম রয়েছে আর সেটা হলো ‘সাদেক’। অবশ্য এই ডাক নাম তেমন কেউ জানে না, অল্প কিছু মানুষ জানে। আমার বড় ভাই মো. মোজামেল হক আদর করে এই নামে ডাকতেন আরকি। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই ডাকার প্রবণতাও তাদের কমে গেছে। কিন্তু আমি মন থেকে মনে রেখেছি সেই নাম।

ছোট বেলায় বড় হয়েছি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা ইউনিয়নের বেলতলী পাড়া নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। সেখানেই আমার জন্ম হয়েছিল।

আমরা মোট দুই ভাই তিন বোন। তবে আমার বাবা ২টি বিয়ে করেছিলেন। আমরা হলাম আমার বাবার ২য় স্ত্রীর ঘরের সন্তান। আগের স্ত্রীর ঘরেও দুই ভাই ও তিন বোন রয়েছে। সেই স্ত্রী মারা গেলে আমার মা’কে বিয়ে করেছিলেন। জন্ম ক্রমিক হিসেব করলে আমি রয়েছি চার নম্বরে।

আমি আমার স্মৃতিচারণ অবশ্য ২০০২ সাল থেকে করতে পারবো। তখন আমার বয়স ৮ বছর। তখন থেকে বেশ অনেক কিছু মনে আছে। আমাদের গ্রামটি ছিল অনেক সুন্দর। গ্রাম থেকে দেবীগঞ্জ শহরের দূরত্ব ছিল প্রায় ৩ কিলোমিটার। গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে একটি ছোট নদী বয়ে গিয়েছিল যেটা এখনও আছে কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়ই আর পানি থাকে না। ধীরে ধীরে নদীটা ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

গ্রামের পূর্ব পার্শ্বে যে নদী সেই নদীর এপার ওপার মিলে বহু জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকতো। রাখাল’রা সেখানে গরু চড়াত। অনেক গাছপালা ছিল। ইচ্ছে করলেই নদীতে এসে এক অসাধারণ পরিবেশ অনুভব করা যেত। কিন্তু বর্তমানে কোন গাছ-ই নাই, ধুধু মরুভূমির মতো। আমি ২০২০ সালের পরের কথা বলছি। এখন নদী ধারের প্রায় প্রতিটি জমিতে বিভিন্ন চাষাবাদ করা হচ্ছে।

আমার মনে আছে, আমি ছোট বেলায় গোবর কুড়াতাম। ভাড় হিসেবে বিক্রি করতাম। ১ ভার গোবরের দাম ছিল ১০ থেকে ১২ টাকা। সেই টাকা দিয়ে নিজের শখ পূরণ করতাম, পরিবারে কিছু টাকা দিতাম।

আমার বাবা সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। আমার বাবা দেখতে কালো ছিলেন। কিন্তু চেহারা বেশ মায়াবী ছিল। মুখের কাটিং বেশ সুন্দর ছিল। তিনি বাশের কাজ করতেন। পড়ালেখা কিছুই জানতেন না। নিজের নামটিও লিখতে পারতেন না। একদম সাদা মনের মানুষ ছিলেন। আমার দেখা মতে, তিনি কোনদিন কারও সাথে ঝগড়া করেননি। কারও সাথে বিবাদে জড়াননি। আগে তো জমি-জায়গা নিয়ে প্রায়ই মারামারি হতো। কিন্তু আমার বাবাকে আমি এসব নিয়ে কোনদিন ক্ষুব্ধ হতে দেখিনি।

সারাদিন মানুষের বাড়িতে কাজ করার পর হয়তো কিছু টাকা পেতেন, সাথে পেতেন চাল। সেই চাল বাসায় নিয়ে আসলে মা রান্না করতো। তখন আমাদের বেশ অভাব ছিল। তিন বেলা ঠিক মতো খাওয়াটাই বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। আর বাবা যাদের বাসায় কাজ করতেন বেশিরভাগ সময় তাদের বাসায়-ই দুপুরের খাবার খেতেন।

বাবার বাশের কাজের ধরণ ছিল খুব সুক্ষ্ম। প্রতিটি কাজ অনেক সুন্দর করে করতেন। এমন কোন মানুষ খুঁজে পাবেন না যে, তার কাজ পছন্দ করতেন না। এই ২০২৪ সালেও হয়তো এলাকার কোন কোন বাড়িতে বাবার কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এখনও অনেকেই আমার বাবার বাশের কাজের জন্য ধন্যবাদ দেয় এই বলে যে, তার কাজ অতি নিখুৎ ও সুন্দর ছিল। আমার বড় মামাও বাবার সাথে কাজ করতেন। মূলত আমার বড় মামার পেশা কৃষি হলেও এই কাজ করতেন। আমার মোট তিন মামা। তিন মামা-ই কৃষি কাজ করতেন।

আমার বাবা বাঁশের কাজ করলেও তিনি কখনো আমাদের ছোট ছোট আবদার পূরণ করতে বাদ রাখেননি। সপ্তাহে অন্তত ২ দিন বাজারে যেতেন। বাজার থেকে প্রয়োজনীয় সদাই কেনার পাশাপাশি আমাদের জন্য কিছু কিনে আনতেন। আমরা সন্ধ্যা হলেই বাবার অপেক্ষায় থাকতাম। সেই সময়টাতে আমরা টাকা পয়সার দিক থেকে গরীব থাকলেও মনের মধ্যে অনেক শান্তি ছিল। অল্পতেই তুষ্ট থাকতাম। মনের মধ্যে সুখ-শান্তি ছিল।

আমি খুব ছোটবেলা থেকেই ঘুড়ি উড়াতে খুব পছন্দ করতাম। নিজে নিজে ঘুড়ি তৈরী করতাম। বিভিন্ন ধরণের ঘুড়ির নামগুলোও প্রায় ভুলতে বসেছি। সুতো কিনার টানা থাকতো না। বাবার কাছ থেকে কোনরকমে যদি ২ টাকা বা ৫ টাকা নিতে পারতাম তাহলেই দৌড় দিতাম গ্রামে থাকা এক চুরি ফিতার দোকানদারের বাসায়। সেখানে গিয়ে কাপড় সেলাই করার সুতা কিনতাম। সেই সুতো দিয়ে ঘুড়ি উড়াতাম। ঘুড়ি উড়িয়েই যেন বিশ্বজয় করে ফেলতাম। আর নাইলন সুতো কেনা যেন বিলাসবহুল ব্যাপার ছিল। গ্রামের আমার এক চাচা হযরত আলী নাইলন সুতো দিয়ে ঘুড়ি উড়াতেন। উনাকে দেখে আমার হিংসা লাগতো, কবে যে আমি নিজে নাইলন সুতো কিনে ঘুড়ি উড়াতে পারবো।

বলা বাহুল্য, আমার ঐ চাচা খুব সুন্দর করে ঘুড়ি তৈরী করতে পারতেন। আমাকে আজগর কাকা বলে ডাকতেন।

চলবে…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top