ঢাকা শহর অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। কেউ কেউ মনে করেন, ঢাকা শহরে আসলেই বুঝি একটা রুটি রোজগারের ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। হ্যা, এখানে অনেক কাজ-কর্ম রয়েছে কিন্তু একটি মানসম্মত কিংবা মোটামুটি ভালো মানের কর্ম খুঁজে নিতে আপনার পরিচিত মানুষ থাকতে হবে যে কিনা আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
সেই জন্যই হেডলাইনটায় এমন কথা বলা হয়েছে। রঙিন শহরে আসলেই জীবন রঙিন করা যায় না। জীবন রঙিন করার জন্য দরকার নিজের ইচ্ছা, ধৈর্য্য শক্তি, পরিশ্রম আর চেষ্টা। এগুলো যার মধ্যে নেই সেই ব্যক্তি কোনদিনই ভালো কিছু করতে পারবে না কিংবা ভালো কিছুর সন্ধান পাবে না।
একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরছি। আমার বন্ধু জাহাঙ্গীর (সম্পর্কে মামাতো ভাই), সে কয়েকদিন পূর্বে ঢাকায় এসেছিল (২০২৪ সালে)। ঢাকায় আসছে আমাকে বলেনি। আমি তার পাশেই থাকি অর্থাৎ সে আসছে ঢাকা উত্তরাতে আর আমি থাকি দক্ষিণখানে। কয়েকদিন পরে আমাকে জানালো যে, সে দক্ষিণখানে এসেছে।
আমি জানার পরে খুশী হলাম। কারন, এলাকার কারও সাথেই তেমন দেখা হয় না। কেউ ঢাকা শহরে তবেই তো দেখা হয়। হঠাৎ গ্রামের কাউকে দেখলে মনটা আনন্দে ভরে যায়। কারন, কতোদিন পরে মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়। তো জাহাঙ্গীরের আসার কারনে আমার মনটাও খুশিতে ভরে উঠছিল।
ওকে আমার ঠিকানার কথা বললাম। ও থাকে আব্দুল্লাহপুর আর আমি দক্ষিণখানে। ওর ওখান থেকে আমার এখানে আসতে সর্বোচ্চ সময় লাগবে ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট আর টাকা খরচ হবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। ওকে আমি আসতে বললাম। কসাইবাড়ীতে আসতে বলেছি অর্থাৎ ও ওখানে এসে আমাকে কল দিলে আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম।
কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ যে, আমি ওর সাথে দেখা করতে পারিনি। আমিও সময়ের অভাবে যেতে পারিনি আবার সে ফ্রি থাকা স্বত্বেও আমার কাছে আসতে পারেনি। ও কিন্তু ইচ্ছে করলেই আমার কাছে আসতে পারতো। কারন, প্রয়োজনটা ওর। ওর একটা চাকরির দরকার। তাহলে আমি যেহেতু একটি প্রাইভেট জব করি তাই আমার সময় কম থাকতেই পারে। আর ইচ্ছে করলেই আমি আমার কাজের এরিয়ার বাইরে যেতে পারি না।
কয়েকদিন পরে সে আমাকে জানায় যে, ওর একটা চাকরির কথা চলছে। কি চাকরি? সে বললো যে, ওয়ালটন শোরুম এর সেলস ম্যানেজার পদে চাকরি। আমি শুনে বললাম যে, এটা তো খুব ভালো একটা খবর। এই চাকরি তো অনেক আরামের। ন্যুনতম ২৫ হাজার টাকা স্যালারী আবার থাকা ফ্রি কেবল খাওয়া নিজের। এই সময়ে এটা তো বেকারদের জন্য স্বপ্নের মতো চাকরি।
তারপরের দিন আমাকে জানালো যে, ও ইন্টারভিউ দিতে যাবে। হাউজ বিল্ডিং এলাকার কামাত পাড়ায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, ওখানে কি ওয়ালটনের শোরুম আছে? সে উত্তরে বললো যে, সে জানে না। আবার বললো যে, তাকে ১০০০ টাকার মতো সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছে। আর এই কথা শোনার পরই আমার মনের মধ্যে খটকা লেগেছে।
আমি তাকে বললাম যে এই বিজ্ঞপ্তি তুই কোথায় পেয়েছিস? সে বললো ম্যাসেঞ্জারে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ওকে তখন আমি বললাম, তুই এই বিজ্ঞপ্তির কথা আমায় আগে বলিস নি কেন? এটা তো সম্ভবত ভুয়া। ওর কাছে ওই বিজ্ঞপ্তির লিঙ্ক চাইলাম। সে আমায় লিঙ্ক পাঠাতে পারলো না কিন্তু স্ক্রীনশট দিলো। যাই হোক, সেই বিজ্ঞপ্তি দেখে আমি ১০০% শিউর হলাম যে, বিজ্ঞপ্তিটি সম্পূর্ণ ভুয়া।
পরে ওকে বুঝিয়ে বললাম। ওর তো অনেক বিপদও হতে পারতো। ঢাকা শহর সম্বন্ধে ওর কোন ধারণাই নাই। অনার্স পাস করেছে ঠিকই কিন্তু আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তার যোগ্যতা আসলে পূর্ণতা পায়নি এখনো। আমি বুঝিয়ে বলার পরে সে আমার কথা শুনেছে।
এরপর আমি তাকে বললাম সময় করে আমার কাছে আসতে। তখন বিভিন্ন আলোচনাও করা যাবে আবার কোন চাকরি নিয়েও কথা বলা যাবে। সে রাজি হলো ঠিকই কিন্তু শেষমেষ আর আমার কাছে আসতে পারেনি।
বলা বাহুল্য, অনার্সে পড়ার সময় ও আর আমি খুবই কাছের ছিলাম। আমার একটি কম্পিউটারের দোকান ছিল আর ওখানে এসে সে প্রায় সময়ই সময় দিতো। আমি সেসব দিনের কথা ভুলবো না। আমি কম্পিউটারের যতোটুকু জানতাম তার সবটুকুই তাকে শেখানোর চেষ্টা করেছি।
তো সে হঠাৎ বিয়ে করেছে আর এই বিয়ের খবর পর্যন্ত আমি পাইনি। এই বিয়ের খবর পেয়েছি আমি সম্ভবত ২ মাস পরে। ম্যাসেঞ্জারে তাদের দুজনার ছবি চেয়েছিলাম সেটাও আমাকে দেয়নি। আমি তাতে কিছু মনে করিনি। কারন, ইসলামে এভাবে ছবি শেয়ার তো দূরের কথা – ছবি উঠানোই নিষিদ্ধ।
এরকম অনেক ঘটনা রয়েছে। কিছু ঘটনা সুখের আবার কিছু ঘটনা দুঃখের। ওই সব বিষয় মনে হলে খারাপ লাগে। সময়ের স্রোতে সম্পর্কগুলোতে ঘুন ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কিন্তু আগের মতো যদি গুরুত্ব থাকতো তবে হয়তো এমন কিছু ঘটতো না।
এরপর আমি জানতে পারলাম, জাহাঙ্গীর মূলত হাউসবিল্ডিং এলাকায় তার শশুর-শাশুড়ির কাছে থাকতো। তার শশুর শাশুড়ি গার্মেন্টস-এ চাকরি করে। জাহাঙ্গীরকে গার্মেন্টস-এ চাকরি নিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু তারা পারেনি। পারেনি বললে ভুল হবে – তারা বলেছে কিছুদিন দেরি হবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর আমাকে বলেছে যে, তার পক্ষে আর ঢাকা শহরে থাকা সম্ভব নয়। তার কোন চাকরি হচ্ছে না, কেউ তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারছে না।
অথচ এই পুরো ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৭ দিনের মধ্যে। অর্থাৎ ১ সপ্তাহের মধ্যে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তো সেজন্যই বলেছিলাম যে, ঢাকা শহর রঙিন কিন্তু জীবন রঙিন নয়। জীবনকে রঙিন করতেে ধৈর্য্য ধরতে হয়, চেষ্টা করতে হয়, অপেক্ষা করতে হয় আর অনেক কিছু। ঢাকা থেকে সে কবে চলে গেছে আমি সেটাও জানি না। আমাকে জানানোর কোন প্রয়োজনই পড়েনি তার।
পরিশেষে বলা বাহুল্য, এই রঙিন শহরে কেউ ভালো কিছু করতে চাইলে ধৈর্য্য ধরতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে হবে না। যারা ঢাকায় থাকে তাদের সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। সবাই যে বুকে টেনে নেবে এমন নয়, কিন্তু সবাই আবার ধাক্কা দিয়ে ফেলেও দেবে না। অনেকগুলো অমানুষের মধ্যে দু’একজন মানুষ থাকে।
যারা স্বপ্ন দেখছেন ঢাকা শহরে আসবেন, কোন চাকরি খুঁজবেন, জীবন গড়বেন – তাদের আমি স্বাগত জানাই। কারন, ঢাকাতে জীবন গড়ার জন্য যতগুলো অপশন রয়েছে আর কোথাও এমনটি নেই। গ্রামে তো আরও নেই। তাই মন চাইলে ঢাকায় আসুন। তবে অবশ্যই ঢাকা সম্পর্কে জেনে আসবেন। এখানে মুহূর্তেই অনেক দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তিলে তিলে জমানো সবকিছু মুহূর্তেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। ঢাকা শহর যেমন ভালো তেমন আবার খারাপ। সারাদিনে অনেক অঘটন ঘটে। আপনি হয়তো সেসব তালিকায় থাকবেন না যদি আপনার মধ্যে সব ব্যাপারে সচেতনতাবোধ থাকে। পরিশেষে, আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো!
আরও পড়ুন: আপনি কেন রাগ করেন তা কি আপনি জানেন!