মানুষ একা চলতে পারে না। কোন না কোন সময় কারও না কারও উপর মানুষকে ভরসা করতেই হয়। আল্লাহতায়ালার উপর ভরসা আমরা সবসময়ই করি। কিন্তু তিনি তো আর নিজে এসে সমস্যার সমাধান করে দেন না। কারও উছিলায় তা করে দেন। সেই উছিলার জায়গাটিতে থাকে মানুষ। তাই স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, আমরা মানুষের উপর ভরসা করি।
এখন, আপনি কেমন মানুষের উপর ভরসা করবেন? এটার উত্তর কখনো অগ্রিম জানা যায় না। সময় আর পরিস্থিতি আপনাকে তা বুঝিয়ে দেবে। আমরা যদি আগেই জানতাম যে, আমরা বিপদে পড়লে এমন মানুষের উপর ভরসা করবো – তাহলে সহযোগিতা পাবোই পাবো তাহলে আমাদের জীবনে আর কোন সমস্যা থাকতো না।
তবুও কিছু লক্ষণ দেখে বুঝে নেয়া সম্ভব যে, এমন মানুষের উপর ভরসা করা যায়। সহযোগিতা পাবো কিনা পাবো না সেটা পরের ব্যাপার।
আপনি যদি আপনার পরিবারে বাস করেন তাহলে অবশ্যই আপনি পরিবারের প্রতিটি মানুষের উপর ভরসা করতে পারেন যদি তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো থাকে। কোন মনোমালিন্য না থাকে। তবে আমি দেখেছি যে, বোনদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে ভাইদের তুলনায় বোনদের কাছে ছোট ছোট ব্যাপারে বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায়। সহযোগিতা পাওয়ার মানুষটি (যার সহযোগিতা প্রয়োজন) হতে পারে ভাই বা বোন বা অন্য কেউ।
এখানে মা-বাবার কথা আলাদাভাবে বললাম না। কারন, মা-বাবা সবসময়ই সন্তানের ভালো চান। তারা সন্তানের প্রতিটি চাওয়া পাওয়া পূরণ করার চেষ্টা করেন। তবে সন্তানের চাওয়া পাওয়াগুলো যেন সৎ থাকে। সব যেন বিলাসিতার না হয়।
এরপর আপনি নির্ভর করতে পারেন আপনার পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোর উপর। তবে সবার উপর তো কখনোই নয়। চারপাশের সব মানুষের সাথে আপনার ভালো সম্পর্ক কখনোই থাকবে না। যাদের সাথে ভালো সম্পর্ক নেই তারা আপনাকে স্বাভাবিক অবস্থায় সহযোগিতা করবে না। কিন্তু আপনি যদি কোন বড় বিপদে পড়েন তবে দেখা যায় তাদের মধ্যে থেকেও কেউ কেউ আপনাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে। তবে সেটা আশা করা যাবে না। আশা করাটা বোকামীর পর্যায়ে পড়বে।
আপনার অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকতে পারে। তাদের কাছেও আপনি সহযোগিতা পেতে পারেন। তবে সবার কাছে তো কখনোই নয়। যাদের বাসায় আপনি নিয়মিত যাতায়াত করেন, কলা-কুশল বিনিময় করেন তাদের কাছে সহযোগিতা পাওয়াটা সহজসাধ্য। কিন্তু যাদের বাসায় আপনি নিয়মিত যান না, খোঁজ-খবর নেন না কিংবা তারাও আপনার বাসায় আসে না তাদের কাছে আপনি কখনোই সহযোগিতা আশা করবেন না।
পরিবার থেকে শুরু করে যে স্তরেই আপনি যান না কেন, যার সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো আছে, যাকে আপনি কোন না দিক থেকে সহযোগিতা করতে পারেন কেবল তারাই আপনাকে সাহায্য করবে। তবে ভরসা করার ব্যাপারটি উহ্য। আসলে বিপদে পড়লে আপনি শুধু আল্লাহর উপরই ভরসা করবেন। আর তিনি কারও না কারও উছিলায় আপনার দ্বারে সহযোগিতার হাত পাঠিয়ে দেবেন। আপনি কোন মানুষের কাছে সরাসরি ভরসা করবেন না। এমনটা ভাববেন না যে, আমি বিপদে পড়লে ওমুক লোকটা আমাকে বাঁচাবে। তাহলে আপনার ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ভরসার জায়গাটি গ্রামের চেয়ে শহরে সহজ হয়। কারন, শহরে মানুষও বেশি আবার সবার কাছেই কিছু না কিছু টাকা পয়সা থাকে। গ্রামের চেয়ে শহরে সবকিছুই বেশি। মানুষ অন্যের উপর যতোগুলো ব্যাপারে ভরসা করতে পছন্দ করে তন্মধ্যে টাকা-পয়সা অন্যতম। কারন, বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের টাকা-পয়সা সবার আগে প্রয়োজন হয়, কিছু কিছু ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় ছাড়া।
তবে বর্তমান যুগটা ‘গিফ এন্ড টেক’ দিয়ে চলছে। কারন, আপনি যাকে কিছু দিতে পারবেন না তার কাছে কিছু চাইতেও পারবেন না। কিন্তু তবুও আমরা চাই। এই চাওয়ার কতো অংশ প্রাপ্তিতা পায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা বিপদে পড়ে তাদের জিজ্ঞেস করলেই বুঝবেন। এ যুগে আপনার যদি কাউকে কিছু দেয়ার মতো না থাকে তবে কারও কাছে কিছু চাওয়াটাও বেমানান। কিন্তু ইসলামে কখনো এমনটা শিক্ষা দেয়া হয়নি। আপনার যথেষ্ট আছে, কেউ বিপদে পড়লে আপনি তাকে সহযোগিতা করবেন এটাই নিয়ম।
এখন আমি সরাসরি কিছু উদাহরণ দেব ‘জীবনে কেমন মানুষের উপর আপনি ভরসা করবেন’ সেই বিষয় নিয়ে।
১. ধরুন, আপনি কোন চাকরি করেন। তাহলে আপনার অনেক কলিগ থাকতে পারে। আপনার অফিসে আরও অন্যান্য পদে লোকবল থাকতে পারে। অফিসের আলাদা লোকজন থাকতে পারে। এখন, আপনি কখনোই আপনার কলিগদের উপর পুরোপুরি ভরসা করবেন না। কারন, তারা আপনার সম্পর্কে সবকিছুই প্রায় জানে। কেউ যে হেল্প করবে না তা নয়। কিন্তু সবাই সহযোগিতা করবে না এটাই বাস্তব। তাই, আপনার থেকে আলাদা পজিশনে আছে, আলাদা সেক্টর, মাঝে মধে দেখা হয়, আপনার সাথে সরাসরি কাজের যোগসূত্র নেই – এমন মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করুন। সেই মানুষটির ছোট ছোট প্রয়োজনে (আপনার সামর্থ্য থাকলে) আপনি হাত বাড়িয়ে দিন। তাহলে তার উপর আপনি নিশ্চয়ই ভরসা করতে পারেন। আপনার প্রয়োজনে তাকে আপনি অবশ্যই পাশে পাবেন। অভিজ্ঞতা থেকে বললাম।
২. আপনার ভালোবাসার মানুষের কাছে অবশ্যই ভরসা করবেন। সেই মানুষটির কাছে কিছু না থাকলেও সে অন্য জনের কাছ থেকে এনে হলেও আপনার পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু আমি অনুরোধ করে বলবো, সেই মানুষটির প্রতি আপনার যেন কোন অভিযোগ না থাকে, ভালোবাসার যেন কমতি না থাকে। ভালো ব্যবহার করতে তো আর টাকা-পয়সা লাগে না। সুতরাং অন্তত ভালো ব্যবহার করবেন। বিষয়টি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য প্রযোজ্য।
৩. আপনার প্রিয় বড় ভাই যদি থাকে তবে তার উপর অবশ্যই ভরসা করবেন। কারন, ভাই আর ভাই এ সম্পর্ক এক অনন্য সম্পর্ক। এ সম্পর্কে ফাটল ধরে কেবল ঘরে পত্নীগণ এলে। তখন তারা খুব ভালো সম্পর্কগুলো সহ্য করতে পারে না। ভাই থেকে ভাইকে দূরত্বে নিয়ে যেতে তাদের ৬ মাস সময়ও লাগে না। কিন্তু আপনারা ভাইয়ে ভাইয়ে যদি এক থাকেন, সৎ থাকেন তবে আপনাদের মধ্য খানে কেউ কাটাতারের বিছানা বিছাতে পারবে না। তো এই ভাইয়ের কাছে আপনি যেকোন সময়ই সহযোগিতা পেতে পারেন।
৪. কিছু বন্ধু আপনাকে সবসময়ই সাহায্য করবে। এখন আপনি যদি বেছে বেছে যাদের টাকা আছে কেবল তাদের সাথেই সম্পর্ক তৈরী করেন তাহলে মস্তবড় ভুল করবেন। কারন, টাকাওয়ালা বন্ধুরাই যে সবসময় পাশে থাকে বিষয়টি তা নয়। টাকা ছাড়া বা কম টাকাওয়ালা বন্ধুরাই বেশি পাশে থাকে। তাই কম টাকাওয়ালা ও বেশি টাকাওয়ালা সবার সাথেই ভাতৃত্ববোধ বজায় রাখেন। প্রয়োজনে যে কাউকে পাশে পাবেন এবং মানুষ চিনতে পারবেন। বাইরে থেকে সবাইকে মানুষ মনে হলেও প্রকৃত অর্থে সবাই মানুষ নয়। মনুষত্ববোধ সবার মধ্যে থাকে না। মনুষত্ববোধ যদি সবার মধ্যে থাকতো-ই তবে আপনার আর কারও উপর ভরসা করতে হতো না। আপনি বিপদে পড়লে আপনা-আপনি-ই সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতো। কিন্তু এমনটা কল্পনাও করবেন না।
৫. সর্বোপরি ভালো মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করুন। যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, মাথায় টুপি দিয়ে রাখে তারাই যে ভালো মানুষ তা নয়। ভালো মানুষ হলো তারা যাদের মনটা ভালো, মনটা নরম। অপরের বিপদে তারা মুহূর্তেই কেঁদে উঠে। অপরের বিপদে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, চুপ করে বসে থাকতে পারে না। এমন মানুষ যে কেউ হতে পারে। আপনার কাছের, দূরের কিংবা আপনি চিনেন না এমন কেউ। সুতরাং আপনার সামর্থ্য থাকলে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করুন। তাদের মনে রাখুন। জীবনে কাজে আসবে।
পরিশেষে আমি বলবো, জীবনে ভরসা করতে হয়। কারন, আমরা মানুষ। আমাদের জীবনে ভুল থাকবে, আমরা বিপদে পড়বো, আমাদের সাথে কারও শত্রুতা হবে এই সবকিছুই স্বাভাবিক। আল্লাহতায়ালা আমাদের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। সুতরাং পরীক্ষা তো আর খুব সহজ হয় না। এটা সারা জীবনের পরীক্ষা। স্কুলের ১ বছর পড়াশোনা করার পরে যে পরীক্ষা সেই পরীক্ষার মতো মোটেও নয়। এই জীবন পরীক্ষায় আপনাকে প্রতিটি পা হিসেব করে ফেলা দরকার। প্রতিটি পদক্ষেপে আপনার ভাবা উচিত যে, আপনি ভুল করছেন কিনা। আর সবসময় যে অপরের উপর শুধু ভরসাই করবেন বিষয়টি এমন নয়। আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী আপনি যতোটুকু সহযোগিতা করতে পারেন তা অবশ্যই করবেন। কারন, সারাজীবন আপনি একরকম থাকবেন না। পরিবর্তন আসবেই। আর এই পরিবর্তনের সাথে নিজেকেও ভালোর দিকে পরিবর্তন করবেন। এক জায়গায় থেমে থাকবেন না। সবার জীবনের সাফল্য কামনা করছি।
আরও পড়ুন: মো. আজগর আলীর জীবন ইতিহাস