আমি ২০১১ সালে এসএসসি পাশ করি। আর এইচএসসি পাশ করি ২০১৩ সালে। তারপর কি করতে চেয়েছিলাম আর কি করেছি তা এই লিখায় পাবেন। কিন্তু পাশের পরপরই আমার সাথে এক দূর্বিষহ ঘটনা ঘটেছিল অর্থাৎ আমি প্রায় ঘটিয়েই ফেলেছিলাম। শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরে এসেছি। আজ সেই ঘটনাটাই শেয়ার করবো আপনাদের সাথে।
আমি এইচএসসি পাশ করি ২০১৩ সালে। সে সময় দেবীগঞ্জ সরকারি কলেজ (বর্তমান নাম) এর নাম ছিল দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ। আমি পাশ করার কিছুদিন আগেই সেটা সরকারি হয়ে যায় এবং আমি আমার সার্টিফিকেট-এ সরকারি ট্যাগ পাই।
আমি বিজ্ঞান বিভাগে পড়তাম। তখন আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসতাম। তার সাথে নিয়মিত কথা বলতাম। দেবীগঞ্জে কলেজের সাথেই এক স্যারের বাসায় (লুৎফর রহমান, গণিত বিভাগ) মেসে থাকতাম। উনি খুব ভালো একজন টিচার ছিলেন। খুব সুন্দর করে পড়াতেন আর উনার কোন বই দেখতে হতো না। জানি না, উনি বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন!
তখন রসায়নটা আমার কাছে বেশ কঠিন লাগতো। যাই হোক, এভাবেই পড়াশোনা চলছিল। এভাবে চলতে চলতে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চলে আসলো। আমি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করলাম। তারপর ফলাফল দেবার আগ পর্যন্ত বাসায় রয়ে গেলাম।
তারপর ফলাফল দেবার সময় আসলো। ফলাফল দিলেও দিলো। আমি পেলাম 3.60. এসএসসিতে আমার ছিল 4.56. তো এসএসসির তুলনায় ইন্টারে আমি খারাপ করে ফেললাম। তবে ইন্টারে আমার সাথে যারা পড়তো তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন A+ প্রাপ্ত ছিল। তাদের মধ্যেও ফেইল করেছে। বেশিরভাগই ফেইল করেছে রসায়নে। আল্লাহর রহমতে আমি পাশ করে বের হয়ে আসতে পেরেছি। সেই বছর সর্বোচ্চ রেজাল্ট ছিল 4.00. সেই হিসেব করলে আমি আমি যে একদম খুব খারাপ করেছি তা নয়। কিন্তু এই ফলাফল আমার পরিবারের পছন্দ হয়নি।
আমার একমাত্র বড় ভাই এই ফলাফল নিয়ে খুব অসন্তোষ প্রকাশ করলো। আমার এক মামা (সম্পর্কে) সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিল যার ছেলে কারিগরী স্কুল থেকে এসএসসিতে A+ প্লাস পেয়েছিলো। তার সাথে কমপেয়ার করে আমাকে অনেক কথা বলা হলো।
আমাকে প্রচুর পরিমাণে গালি-গালাজ করেছে সেদিন। আসলে এখানে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি শুধু কেঁদেছি। বহু মানুষের সামনে আমাকে এই গালিগুলো দেয়া হয়েছে। আমার কোন কথাই শোনা হয়নি। আমাকে সবদিক থেকে অপমান করা হয়েছে সেদিন। আর সবকিছুই করেছে আমার একমাত্র বড় ভাই।
আমার বড় ভাইয়ের একটু বিবরণ দেই। সে প্রচন্ড রকমের রাগী মানুষ। রাগ উঠলে তার কোন হুঁস থাকে না। মায়ের সাথেও তার অসংখ্যবার রাগারাগি হয়েছে। মানুষের সামনে নিজের মা’কেও তিনি অপমান করতে কুন্ঠিত বোধ করেনি। এই বিষয়টি আসলে মেনে নেয়ার মতো নয়। আমার ভাবীর সাথে প্রায়ই ঝগড়া লাগতো। তাকে মাঝে-মধ্যেই অনেক মারধর করতো। তাকে পরিবারের সবাই আমরা খুব ভয় পেতাম। কিন্তু ২০১৮ সালের পর হতে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আমার ভাইয়ের এক মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। ছেলে পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা করে। তো, উনি আর আগের মতো আচরণ কারও সাথে করে না। এখন বেশ ভালো। আল্লাহ হয়তো হেদায়েত দিয়েছেন তাই এমনটা সম্ভব হয়েছে। তবে তার অসংখ্য ভালো গুণও রয়েছে। সেগুলো নিয়ে আমি আরেকদিন কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।
যেখানে ছিলাম – আমাকে প্রচণ্ড রকমের গালাগালি করা হলো। সব দিক থেকে অপমান করা হলো। আমি আসলে মন থেকে এসব মেনে নিতে পারিনি। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি কোথাও চলে যাবো। আর আসবো না কোনদিন।
আমি আমার বন্ধু ভবেশ এর সাথে যোগাযোগ করলাম। তার সাথে সবকিছু শেয়ার করলাম। সেও চলে যাবে। তারও অনেক দুঃখ-কষ্ট। তার মা ছিল না। ছোটবেলায় ফাঁসিতে ঝুলে তার মা আত্মহত্যা করেছে। সৎ মা তার উপর অনেক অত্যাচার করতো।
আমার কথা শুনে সে এক কথায় রাজি হয়ে গেলো। আমার আরেক বন্ধু স্বদেশ সেও আমাদের সাথে চলে যাবে। সেও রাজি হয়ে গেল। তারপর আরও ৩ জন আমাদের সাথে চলে যাবে। তাহলে মোট আমরা ৬ জন হয়ে গেলাম। এই ৬ জনেরই মনের মধ্যে অস্বাভাবিক সব কষ্ট ছিল। আর তাই আমরা বহু দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এবার বলছি, কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম আমরা সেই সম্পর্কে। আমার বন্ধু ভবেশ এর এলাকার এক লোক (বয়স আনুমানিক ২২) চট্টগ্রামে মুরগির ফার্মে কাজ করে। তার সাথে ভবেশ যোগাযোগ করলো। সেই লোক আমাদের আশার বানী শোনালো। উনি বলেছিলেন যে, ৮ ঘন্টা ডিউটি করতে হবে। থাকা ও খাওয়া কোম্পানীর। বেতন দেবে ১২০০০ টাকা। সেই ২০১৩ সালে এই বেতন কিন্তু কম নয়! আমি তার কথায় খুব খুশি হয়ে গেলাম।
সবাই তলে তলে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। এখন বাইরে গেলে তো অন্তত ৫০০০ টাকার দরকার। হাতে তেমন কোন টাকা ছিল না। যাদের কাছে চাইলে পাবো তাদের কাছ থেকে ৫০০০ টাকাই ধার করলাম। অবশ্য নিজের কাছে অল্প কিছু টাকা ছিল। বাকি সবারও টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। এখন, দলের মধ্যে আমি ছিলাম নামকড়া। সবার মা-বাবাই আমাকে চিনতো আর খুব খুব বিশ্বাস করতো। কারন, হাই স্কুলে ক্লাস সিক্স হতে টেন পর্যন্ত আমার রোল নম্বর ১ ছিলো। এছাড়া আমি ছিলাম ভদ্র ও নম্র স্বভাবের। এখনও ইনশাআল্লাহ তেমনি আছি। সবমিলে আমায় সবাই খুব ভালোবাসতো।
এখন, বাসায় বললাম যে – আমি রংপুর যাচ্ছি কোচিং করতে। শুধু মাত্র একটি বালিশ আর একটি কাথা নিয়েছিলাম সাথে। আমার মা আমার হাতে ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। মায়ের দিকে চেয়ে আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম। মা তো আর জানতো না যে, আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি।
যেদিন চলে যাবো সেদিন সবাই সময় মতো বাসা থেকে বের হয়ে আমাদের করতোয়া ব্রীজ পাড় নামক জায়গায় চলে আসলাম। সবাই এক জায়গায় হলাম আরকি। তারপর ঠাঁকুরগাও এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কারন, ঠাঁকুরগাও ছাড়া চট্টগ্রামের গাড়ি পাওয়া যায় না।
সেখানে পৌছার পরে টিকেট কেটে ফেললাম। এখন সেই লোকের সাথে আমাদের যোগাযোগ চলছিল যিনি আমাদের চাকরি নিয়ে দেবে। সে হঠাৎ সেই সময় আমাকে ফোন দিয়ে বলতেছে যে, আমাদের সবার ১ হাজার করে টাকা তাকে আগে পাঠাতে হবে। আমি বললাম যে, আমরা তো যাচ্ছিই আপনার কাছে। তাহলে আগে টাকা দিতে হবে কেন! তার নাছোরবান্দা – তাকে দিতেই হবে। তখন তার কথায় আমার সন্দেহ হলো। আমি মনটাকে একটু সরিয়ে আনলাম। কিন্তু তখনও যাওয়ার আশা বাদ দেই। টিকিট কাটার পরে গাড়ি তো আধা ঘন্টা পরে ছাড়ে। ঠিক সেই সময়টায় এই ঘটনা।
ঠিক এই সময় আমার বাসায় স্বদেশ নামক বন্ধুটার মা-বাবা এসেছে। তারা এসেছে বলেছে যে, আজগর আর স্বদেশ তো চট্টগ্রাম যাচ্ছে কাজ করতে। মানে আমার বন্ধু স্বদেশ তার মা-বাবাকে সত্য কথাই বলে এসেছে। তো এই খবর আমার মা জানার পরে খুব ইমার্জেন্সী আমার ভাইকে জানায়। তখন আমার ভাই তার শশুরবাড়িতে। আর ভাইয়ের শশুরবাড়ি ছিল চেংঠিতে অর্থাৎ ঠাঁকুরগাও হতে বেশ কাছে।
ভাই এই কথা শোনার পরে ভাইয়ের মাথায় যেন বাঁজ পড়েছে। আমাকে ফোন আর ফোন। কয়েকবার ধরিনি, পরে কল ধরেছি। কারন, আমিও দোটানায় ছিলাম যে, কি করবো এখন! যাবো নাকি যাবো না!
কল ধরার সাথে সাথে ভাই বললো যে, তুই ২০টা মিনিট দাড়া ভাই – আমি আসতেছি। ভুলেও কোথাও যাস নে।
আমি সেদিন আমার ভাইয়ের কথা শুনেছি। কারন, চট্টগ্রামের সেই লোকের কোন ভরসা পাচ্ছিলাম না। আমি সবাইকে থামতে বললাম। যা হবার হয়েছে আমরা আর যাবো না। আমাদের নিরাপত্তা নেই। কাউন্টারে গিয়ে টাকা ফেরৎ চাইলাম। কিন্তু না, তারা টাকা ফেরৎ দিলো না। আমাদের অনেক টাকা লস হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ২ জন আমাদের কথা শোনেনি। তারা যাবেই যাবে। তারা সত্যিই গাড়িতে উঠলো এবং যেতে লাগলো।
তাদের মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করে আমি তাদের থামাতে বললাম। আমি বিস্তারিত বুঝিয়ে বললাম। তখন তারা প্রায় রংপুর শহরে চলে গেছে। রাত প্রায় ১০ টা বাজে। পরে শেষমেষ তারা রাজি হয় এবং রংপুরে গাড়ি থেকে নেমে যায়। সেখানে এক বন্ধুর মেসে থাকার পরে পরেরদিন বাসায় চলে আসে।
পরে আমিও আমার ভাইয়ের সাথে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় আসার পরে আমাকে আর তেমন কিছু বলেনি। কোন গালি-গালাজ করেনি। সুন্দর করে আমাকে কয়েকটি কথা বলে বুঝিয়েছে। আসলে এরকম ঘটনা ঘটলে যা বলা উচিত যতোটুকু বলা উচিত তাই বলেছে। কারন, আমরা তো ভয়াবহ এক ফাঁদে পা দিচ্ছিলাম।
আমার অন্যান্য সঙ্গীরা শুরুতে আমার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করলেও পরে তারাও বুঝতে পেরেছিলো। আমার সিদ্ধান্তে তারাও পরে খুশি হয়েছিল।
সেদিন যদি আমরা সত্যি সত্যি চট্টগ্রামে যেতাম জানি না কি হতো আমাদের সাথে। অনেক খারাপ কিছুও হতে পারতো। একটা কথা আছে, রাখে আল্লাহ মারে কে। তাই শেষ পর্যন্ত আমরা আর যেতে পারিনি।
তো পরিশেষে আমি বলতে চাই, একটা পরীক্ষার ফলাফল জীবনের জন্য কিছুই না আবার অনেক কিছু। কিন্তু একটা পরীক্ষার ফলাফলের জন্য আমার সাথে যেমন আচরণ করা হয়েছে তেমন যেন আর কারও সাথে করা না হয় আমি সেটাই আশা করবো।
কারন, আমার সাথে যা করা হয়েছিল সেদিন তা মেনে নেয়ার মতো নয়। মানুষ এরকম সিদ্ধান্ত কখন নেয়! যখন সে আর সইতে পারে না। মানুষ আত্মহত্যা কখন করে! যখন কোন বিষয় তাকে এতোটা পীড়া দেয় যে, সে আর সইতে পারে না তখন।
যেদিন পরীক্ষার ফলাফল দেয় সেদিন অন্তত পরীক্ষার্থীকে কিছু বলা উচিত নয় (যদি ফলাফল খারাপ হয়)। কয়েকদিন পরে বলা উচিত। তখন আর তার মন এতোটা ভারাক্রান্ত হবে না। সে জীবনের জন্য কঠিন ও ভয়াবহ এমন কোন সিদ্ধান্তও নেবে না।
আমার বাবাকে হারিয়েছিলাম ২০০৪ সালে যখন আমি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। তারপর থেকে এই ভাই-ই আমাকে বড় করেছে। পড়াশোনার সমস্ত খরচ দিয়েছে। আমাকে নিয়ে তার প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। তবে আমি নিজের দিকে মনোযোগ দিলে আরও একটু ভালো অবশ্যই করতে পারতাম। অন্তত ৪.০০ আমি পেতাম – এটা আমি বিশ্বাস করি। আমার নিজের অবহেলা ছিল। আল্লাহ আমায় মাফ করুক।
কিন্তু তারপরেও আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত। কারন, ইন্টার পাশের পরে একটা ছেলে বা মেয়ের বয়স আর কতোই হয়, বড়জোর ১৮/১৯। তাহলে সেই বয়সে তারা আর কিই-বা বুঝে। সুতরাং শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ছেলেমেয়েদের মনে খুব বেশি আঘাত করা মোটেও উচিত নয়।
আর যারা পরীক্ষার্থী তাদের আমি বলবো, তোমরা অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করিও। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করিও। যতোটুকু সুযোগ থাকে ততোটুকুই তোমার ফলাফল ভালো করার জন্য কাজে লাগানোর চেষ্টা করো। সুযোগ বারবার আসে না, একবারই আসে। যদিও ডিগ্রিতে আমি ফার্স্ট ক্লাস পাই কিন্তু এইচএসসির জন্য আমার এখনও কষ্ট হয়। আমি ইচ্ছে করলেই আরও ভালো করতে পারতাম। তো তোমাদের যেন এই আফসোস করতে না হয়।
আর আমি আমার ভাইয়ের প্রতি আর বিন্দু পরিমাণ অভিযোগ রাখিনি। কারন, তিনি আমায় খুব ভালোবাসেন বলেই আমার খারাপ ফলাফল তিনি সহ্য করতে পারেননি। আপনারা সবাই আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের সবার প্রতিও আমার দোয়া ও ভালোবাসা রইলো।