ওষুধ ব্যাপারটি বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওষুধ ছাড়া আমরা যেন একদিনও চলতে পারি না। আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধকেও ওটিসি বানিয়ে ফেলছি। আর এই জন্যেই সমস্যা আমাদের পিছু ছাড়ে না।
ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের অনেক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আজ এ বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। মনোযোগ দিয়ে পোস্টটি পড়ুন, আশা করি উপকার ব্যতীত অপকার হবে না।
আদিম যুগে আমরা একটু ফিরে যাই। আজ থেকে ১০০ বছর আগে এখনকার মতো এতো রোগ ছিল না। এতো হসপিটাল ছিল না। এতো এতো ওষুধ ছিল না। তারপরেও মানুষ বেঁচে থাকতো প্রায় ১১০ বছর, ১২০ বছর বা তারও বেশি। আর এখন তো ৫০ পার হলে চেহারার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। মানুষ বলে যে এক পা কবরে চলে গেছে।
তখনকার সময়ে কিছু কিছু রোগ ছিল যা অনেক ভয়ংকর। অল্পতেই ছড়িয়ে যেত এবং মহামারী আকার ধারণ করতো। কোন কোন সময় একই গ্রামের ২০ বা ৩০ জন বা তারও অধিক মানুষ মারা যেত। কিন্তু যারা এসব বাধা পেরিয়ে বেঁচে যেত তারা বছরের পর বছর খুব ভালোভাবেই বেঁচে থাকতো।
সেই সময়কার মহামারীগুলো কিন্তু সবাইকে কাবু করতে পারতো না। কারন, মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। এখনকার মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম। কেন কম সেই বিষয়েও আলোকপাত করবো।
আগেকার সময়ের মতো যদি মহামারী রোগগুলো আসতো তাহলে এখন আরও অধিক পরিমাণে মানুষ মারা যেত।
তো আগেকার কথা এজন্যই বললাম যে, আগের মানুষ ভালো খাবার খেত। প্রাকৃতিক খাবার খেত। সব খাবার পুষ্টি সমৃদ্ধ ছিল। কেউ খাবারে বা ফলমুলে ফরমালিন মেশাতো না। ধরে নিলাম মেশাতো কিন্তু পরিমাণটা এখনকার মতো নয়। আগে পরিবেশের চারপাশে প্রচুর পরিমাণে শাক সবজি পাওয়া যেত। সেগুলো সেই সময় কিনতে হতো না। গরু, ছাগলকে মোটা তাজা করণের জন্য এখনকার মতো ইনজেকশন দেয়া হতো না। আর তাই তাদের তেমন ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। তাছাড়া, সেই সময় সাধারন কোন সমস্যায় প্রাকৃতিক গাছ-গাছড়া দিয়ে চিকিৎসা খুব সহজেই নেয়া যেত যদিও কিছু কিছু বিষয়ে কুসংস্কার ছিল। সবমিলে তখন তাদের ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে সচেতন না হলেও চলতো।
কিন্তু এখন আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যে যুগে ওষুধ ছাড়া বেঁচে থাকা কল্পনাও করতে পারবেন না। এই যে কয়েক বছর আগে করোনা ভাইরাস আসলো, হানা দিলো – আপনারা তো নিজ চোখে দেখেছেন কতো মানুষ চোখের সামনে মারা গেল। আমাদের নিজেদেরও কোন ভরসা ছিল না। সবাই ভয়ে ছিলাম – কখন যে আবার আক্রান্ত হয়ে যাই। আমরা যারা সুস্থ ভাবে বেঁচে আছি আজ পর্যন্ত সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলি।
আগেও যেমন মহামারী ছিল সেটা এখনও আছে। শুধুমাত্র ধরণ বদলেছে। আগের মহামারীকে এখন আমরা কিছুই মনে করি না। পোলিও, হুপিং কাশি, ডিপথেরিয়া, ম্যালেরিয়া এখন যেন এসব কোন রোগের মধ্যেই পড়ে না। কারন, এসব রোগের টিকা নিলেই মোটামুটি নিরাপদে থাকা যায়। কিন্তু এখন যেসব মহামারী দেখা দিচ্ছে তা কিন্তু পৃথিবী বাসী ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। করোনায় বহু মানুষ মারা গেছে। হিসাব করে শেষ করতে পারবেন না।
নতুন নতুন রোগ বের হচ্ছে, আবার নতুন নতুন ওষুধও আবিষ্কারও হচ্ছে। কিন্তু তবুও যেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। আমরা যত বেশি ওষুধ গ্রহণ করবো ততোই আমাদের শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। কারন, আপনি দেখবেন প্রতিটি ওষুধের লেবেলে বা ভিতরের নির্দেশিকায় বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলা আছে।
আপনি ওষুধ সেবন করলে নির্ধারিত রোগ থেকে হয়তো রেহাই পাবেন কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কিন্তু আপনার শরীরে থেকে যেতে পারে। সুতরাং কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত ওষুধ সেবনকে আমরা ভালো বিষয় হিসেবে বলতে পারি না।
এখন একটা উদাহরণ দেই। ৬০ বছর বা ৭০ বছর বয়স্ক একজন মানুষের শরীরে নানাবিধ রোগ বাঁসা বাধতেই পারে। কারন, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তখন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তার হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে, ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে, বুকে ব্যথা হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন ঐ ব্যক্তিকে যদি নিয়মিত ব্যথার ওষুধ দেয়া হয় তাহলে হয়তো তার ব্যথা কমবে কিন্তু কিডনীতে ধীরে ধীরে সমস্যা হবে। তাহলে একদিক থেকে সামান্য উপকার হলেও অন্যদিক থেকে তার সমস্যা তৈরী হচ্ছে। সুতরাং ওষুধ যতো কম খাওয়ানো যায়, ততোই ভালো।
লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, উপরে যে উদাহরণ দিলাম এরকম একজন বয়স্ক মানুষকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন তখন ডাক্তার’রা ১০ কিংবা ১৫ প্রকারের ওষুধ দিয়ে দেয়। আসলে ওই বয়সের মানুষগুলো কিন্তু পুরোপুরি সুস্থাবস্থায় আর ফিরে আসে না। হয়তো কোনরকমে বেঁচে থাকে। তার জন্য এই ১০ বা ১৫ প্রকারের ওষুধ সেবন করা খুবই কঠিন কাজ। তাহলে তার জন্য আইডিয়াল হলো যতো কম ওষুধে তাকে সুস্থ রাখা যায়। মানুষ যখন বৃদ্ধ হয় তখন তাকে শুধু শারিরীক সাপোর্ট দিলেই হবে না, তার মানসিক সাপোর্টও খুব প্রয়োজন। মানসিক সাপোর্ট পেলে হার্টের রোগীও অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়।
আবার দেখুন, একজন রোগীকে হাসপাতালে বা ক্লিনিক বা ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেলে তারা পরীক্ষা করে শুধু ওষুধ দিয়ে দেয় – এই পর্যন্তই দায়িত্ব শেষ। কিন্তু ওষুধ চলমান অবস্থায় তার কোন সমস্যা হলো কিনা, কি কি খাবার খাওয়া যাবে আর কি কি খাবার খাওয়া যাবে না সেসব ব্যাপারে সাধারণত কোন খোঁজ রাখা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু নয়, বহির্বিশ্বে এমন সব হাসপাতাল তৈরী করা উচিত যেখানে কোন মুমূর্ষ রোগীকে রাখা হবে এবং তার জন্য একদম প্রাকৃতিকভাবে সমস্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হবে অর্থাৎ ভেজালমুক্ত। কিন্তু আমার এ কথা কেবল আশাই থেকে যাবে – এটা কোনদিনও পূরণ হবার মতো নয়।
আমি জানি না, আমার কথাগুলো আপনারা কিভাবে নিচ্ছেন! আমি এটাই বুঝাতে চাচ্ছি যে, ওষুধ বেশি খাওয়া কখনোই ভালো নয়। জীবনে সবচেয়ে বেশি খেতে হবে প্রাকৃতিক খাবার। প্রকৃতি থেকে সরাসরি যেটা পাওয়া যায় সেটা। মানুষের হাতে তৈরী খাবারে ভেজাল থাকবেই। আর প্রাকৃতিক খাবার খেলে অবশ্যই একজন মানুষ অনেকটা সুস্থ থাকবে এবং তার কম পরিমাণ ওষুধের প্রয়োজন হবে।
আমার নানী যার বয়স প্রায় ৯০ বছর, তিনি এখনও সুই-এ সুতো লাগাতে পারেন। রাতে হাটতে পারেন। তার প্রায় সবগুলো দাঁত ঠিক আছে। আমি যতোদূর জানি, আমার এই নানী জীবনের বেশিরভাগ সময় সবজি খেয়েছেন। পালই শাক, বতুয়া শাক, কচু শাক ইত্যাদি যেগুলো রাস্তার আশেপাশে পাওয়া যায় সেগুলো সংগ্রহ করে খেতেন। তার কোন ডায়াবেটিস নেই। তিনি তো কোন ওষুধই খান না। তাহলে তিনি এই বয়সে এতোটা সুস্থ কিভাবে রইলেন – বুঝে নেন।
আসলে আমরা দোকানে গেলে প্রয়োজন হোক বা না হোক গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নিয়ে আসি। মন চাইলেই খেয়ে নিই। পেট ব্যথা হলে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাই, পেটে ভুটভাট করলে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাই, শখ করে খাই – আর কতভাবে খাই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই কাজটা আমরা চরম ভুল করি। নাপা ট্যাবলেট এর কথা না হয় বাদই দিলাম। এরকম হাজারো ওষুধ আমরা নিজেরাই ওটিসি বানিয়ে ফেলছি। জ্বরের কোন রোগী দোকানে গেলে দোকানদার’রা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেয় (কতিপয় দোকানদার/কেমিস্ট বাদে)। অথচ অ্যান্টিবায়োটিক একটা ভয়ংকর ওষুধ। সরকারি বিধি নিষেধ থাকলেও কেউ এর পরোয়া করে না। কিন্তু এতে করে আমরা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছি।
আবার, আমাদের দেশের ডাক্তারদের দিক থেকেও সমস্যা রয়েছে। রোগীকে নিজেরা ভালো মতো পরখ না করেই বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে দেয়। তারপর টেস্ট করে আসলে আবার প্রয়োজন ছাড়াই অনেক ওষুধ দিয়ে দেয়। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর সাথে টাকার বিনিময়ে তাদের চুক্তি থাকে আর তাই এই কাজ করতে তারা এক প্রকার বাধ্যই হয়। ডাক্তারগণ সমাজের উচু ও সম্মানিত শ্রেণীর পর্যায়ে পড়ে। তারা এই কাজ না করলেও পারেন। এতে করে রোগীরও পকেট কাটা হয় না আর মানুষগুলোও সুস্থ থাকবে।
কিন্তু কথা হলো – সচেতন সবাই হলো কিন্তু পাবলিক যদি সচেতন না হয় তাহলে কোনভাবেই এসব বিষয়ের সমাধান করা সম্ভব নয়। আপনার নিজেকে সমাধানের পথে আনতে হবে। আপনি আজ থেকে নিজে প্রয়োজন ছাড়া ও ভালো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ খাবেন না – প্রতিজ্ঞা করেন। একজন একক মানুষ, তারপর তার পরিবার, তারপর তার গ্রাম, শহর, জেলা, বিভাগ – এইভাবেই সারাদেশে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
আর ওষুধ কোম্পানীগুলোকেও এই ব্যাপারে একটু সজাগ থাকা দরকার। বিভিন্ন অফার, এই সেই এগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত। তাহলে অফারে পাওয়া ওষুধ দোকানদার’রা বিক্রি করার জন্য তোড়জোড় করবে না কারও সাথে।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। ভালো ডাক্তারের দেয়া পরামর্শ অবশ্যই মানবেন এবং ডোজ সম্পূর্ণ করবেন। ওটিসি ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দেন। ব্যথার ওষুধ একান্ত প্রয়োজন ছাড়া খাবেন না। কেমিস্টদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দিন। বেশি করে প্রাকৃতিক সবজি খান। প্রয়োজনে সুযোগ হলে নিজেরা চাষ করুন। সাধারন সমস্যায় দুই একদিন ধৈর্য ধরুন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাবেন না। কোন সময় খেলেও ডোজ পূরণ করুন। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। তাহলে আমরা এমনিতেই অনেকটা সুস্থ থাকবো ইনশাআল্লাহ। রোগ-ব্যাধি আমাদের অবশ্যই হবে, হবে না এমনটি নয়। ওষুধও আমাদের সেবন করতে হবে। কিন্তু আমরা যেন একটি লাইনে থাকি, নিয়ম মাফিক সবকিছু করি। মন চাইলেই যেন যত্রতত্র ওষুধ সেবন না করি। সবার সুস্থতা কামনা করে শেষ করছি।
আরও পড়ুন: এইচএইসসি পাশের পর আমার এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা