২০২৪ সালের জানুয়ারী মাস থেকেই দিনগুলো কোনরকম ভালোই যাচ্ছিল। একটি বেসরকারি কোম্পানীতে চাকরি করি। সুতরাং কাজের চাপ, সেলস টার্গেট এর চাপ তো থাকবেই। সবকিছু মেনে নিয়েই দিনগুলো যাচ্ছিল। জুলাই ২০২৪ – এটিও ভালোই যাচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হলো কোটা সংস্কার আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে প্রবেশে সবমিলে ৪৭% কোটা ছিল। এটা ২০১৮ সালে বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার বলবৎ হয়ে যায়। আন্দোলনটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। দিন রাত সারাক্ষণ মিছিল হতে থাকে। সাধারন মানুষ বুঝতে পারে যে, এই আন্দোলন এতো সহজে থামবে না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে যে, আন্দোলন করলে কোন সমস্যা নেই কিন্তু কোনরকম খারাপ পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরী করা যাবে না। তাহলে কঠোরভাবে দমন করা হবে।
আন্দোলনের তৃতীয় দিন এক ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সারা দেশে এক যোগে মিছিল হয়, মারামারি হয়, পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বহু মানুষ হতাহত হয়। অনেকে মারা যায়। অনেক পুলিশ আহত হয়। সবমিলে আমরা এমন এক পরিস্থিতি দেখেছি যে, যে পরিস্থিতির জন্য দেশের মানুষ কখনো প্রস্তুত ছিলো না।
দেশের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মেট্রোরেল ভাঙচুর করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় আগুন দেয়া হয়েছে। কত গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইন্টারনেট সিস্টেমে আগুন দেয়া হয়েছে। তার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
সেদিন রাত ১২ টার পর থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। আমরা সবাই হয়তো কারফিউ এর মানে বুঝি। একান্ত এবং ইমার্জেন্সী সমস্যা ছাড়া কেউ ঘর হতে বাইরে বের হতে পারবে না। মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট অচল হয়ে যায়। শহরের প্রায় সবজায়গায় সেনাবাহিনী টহল দিতে থাকে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে।
নির্বাহী আদেশে ৩ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় যেখানে সব ধরণের সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত বন্ধ থাকবে। তবে বলতে ভুলে গেছি যে, কোটা সংস্কার নিয়ে আদালত রায় দিয়েছিল এবং সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য ৫%, ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জন্য ১% এবং প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ১% বরাদ্দ রাখা হয়। সবমিলে ৭% কোটা রাখা হয়। এই রায়কে সামগ্রিক জনগণ স্বাগত জানিয়েছে এবং আন্দোলনরত ছাত্ররাও মেনে নিয়েছে। এই খবর আমরা টেলিভিশনে দেখেছি। সত্য কথা বলতে, এই রায় সত্যিই একটি অসাধারন রায় বলে আমার মনে হয়েছে।
তো যেখানে ছিলাম – যেদিন থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো সেদিন থেকে জনজীবন যেন পাল্টে গেল। মানুষ একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছিল না। আমি যে এলাকায় থাকি সেখানকার রাস্তার সংস্কার কাজ চলছিল। তাই পুরো রাস্তাঘাট অকেজো ছিল। আর তাই কোন পুলিশ, আর্মি বা অন্য কোন বাহিনীর কেউ এই এলাকায় আসেনি। আর তাই এই এলাকার মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করেছে।
সমগ্র ইন্টারনেট ব্যবস্থা অচল থাকায় আমরা কোন খবর পাচ্ছিলাম না। দেশের কি অবস্থা, শেষ পর্যন্ত কি ঘোষনা আসলো তা আমরা জানছিলাম না। পরে যেখানে টেলিভিশন আছে সেখানে গিয়ে আমরা খবর দেখছিলাম। আপডেটগুলো নিচ্ছিলাম। সবচেয়ে ভয়াবহ খবর ছিল এটাই যে, দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। আমি লিখা যখন লিখছিলাম তখনও সমগ্র ইন্টারনেট ব্যবস্থা অচল ছিল এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ বলবৎ ছিল। আমি ২৩ জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১টার পরে এই লিখা লিখছিলাম।
আশা করছি, খুব শীঘ্রই দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা সচল হবে। মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং-এ কোন লেনদেন করতে পারছিল না। ব্যাংকগুলো বন্ধ ছিল। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দুরাবস্থা দেখে কে! বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সারাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ ছিল। মানুষ সহজে কারও সাথে যোগাযোগও করতে পারছিল না। হয়তো পরিস্থিতি খুব শীঘ্রই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। জনজীবনে স্বস্তি নেমে আসবে।
তবে আন্দোলনের নামে দেশের সম্পদ বিনষ্ট করার পক্ষে কোন সুস্থ মানুষ নয়। সম্পদ গড়তে সময় লাগলেও বিনষ্ট করতে কিন্তু সময় লাগে না। কিন্তু সেটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে অনেক সময় লাগে। যুগে যুগে সব দেশেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। তাই বলে তারা দেশের সম্পদ বিনষ্ট করেছে এমন শুনিনি। এসব কখনো কাম্য নয়।
ইন্টারনেট ব্যবস্থা অচল হওয়ায় মানুষ বিদ্যুৎ মিটার রিচার্জ করতে পারছে না। পারলেও অনেক হয়রানি হতে হচ্ছিল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনায় পড়েছে সাধারন মানুষ। তাহলে ইন্টারনেট ব্যবস্থা অচল করে দিয়ে মূলত কার ক্ষতি হলো? নিজের দেশের এবং নিজের দেশের মানুষের ক্ষতি হলো। বিদ্যুৎ, জ্বালানী উৎস, রাস্তাঘাট-গাড়ি, শিল্প কারখানা মোট কথা কোন সম্পদের উপরেই ক্ষতির সমীকরণ আকা উচিত নয়। এসব কখনো রাজনীতির নামে আন্দোলন হতে পারে না।
পরিশেষে বলতে চাই, এমন রাজনীতি আমরা চাই না যে রাজনীতি আমাদের মতো সাধারন মানুষের জীবন বিপন্ন করে। রাজনীতি সবসময় সুস্থ ধারায় হোক। রাজনীতির নামে সাধারন মানুষ বলি হোক – তা আমরা চাই না। কোন প্রাণ ঝরুক সেটাও আমরা চাই না। কেউ আহত হোক সেটাও আমরা চাই না। আমরা যেন নিরাপদে রাস্তা-ঘাটে বিচরণ করতে পারি, খেটে খাওয়া মানুষগুলো যেন প্রতিদিন পরিশ্রম করে খেতে পারে, অফিস আদালত যেন সবসময় খোলা থাকে, স্কুলে বাচ্চারা যেন নির্বিঘ্নে যেতে পারে – আমাদের চাওয়া তো এগুলোই। সরকার এবং জনগণের মধ্যে সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক – এটাই চাওয়া। জনগণ আর সরকার তো আলাদা নয়। জনগণ নিয়েই সরকার, জনগণের জন্যই সরকার। সুতরাং বিশেষ কোন ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে একান্তভাবে জনগণের দিকটা সরকারের ভাবা উচিত। ভালো থাকুক আমার দেশের সরকার – ভালো থাকি আমরা সবাই।
আরও পড়ুন: ইসলাম থেকে মানুষ যেভাবে দূরে সরে যাচ্ছে