সম্প্রতি আকস্মিক বন্যায় ফেনীসহ দেশের ১২টি জেলার অনেক অঞ্চল এখনো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। কিছু জেলায় পানি কমতে শুরু করলেও সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। নতুন এলাকাগুলোতে বন্যার পানি প্রবেশের খবর পাওয়া গেছে। কুমিল্লার গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে অন্তত ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
ফেনী জেলার সংকটাপন্ন অবস্থা
ফেনী জেলার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। জেলার সাথে সংযুক্ত ছয়টি উপজেলাই শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় অনেক গ্রামের মানুষের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ভারতের ত্রিপুরা থেকে উজানের ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বন্যা কবলিত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার, এবং হবিগঞ্জ। এসব জেলায় প্রায় ৯ লাখ পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় আছে, যা প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত বন্যায় ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। মিরসরাই থেকে ফেনী পর্যন্ত যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। কিছু কিছু যানবাহন ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত আটকে ছিল, যেখানে শুধুমাত্র ত্রাণবাহী যানবাহন চলাচল করছে। অনেক যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছাতে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন।
উদ্ধার কার্যক্রম
ফেনী জেলায় দিনব্যাপী বন্যাকবলিত মানুষদের উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আগত একটি উদ্ধারকারী দল স্পিডবোটের মাধ্যমে ৭০ জনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে। সীতাকুণ্ড থেকে আগত একটি স্বেচ্ছাসেবী দলও উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছে, যাদের সহায়তায় প্রায় ২০০ জন মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্র বা মহাসড়কে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত গ্রামগুলো
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে অন্তত ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, যা দুই লক্ষাধিক মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে এখনো পানি প্রবেশ করছে এবং আশপাশের এলাকার মানুষজন সংকটময় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। সেখানে নারী, পুরুষ, এবং শিশুরা আশ্রয় নিয়েছে। শুকনো খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের সংকট রয়ে গেছে।
নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের অবস্থা
নোয়াখালীতে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, কারণ উজানের পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। জেলার আট উপজেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ বর্তমানে পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। লক্ষ্মীপুরেও বন্যার পানি কিছুটা বেড়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অন্যান্য জেলার পরিস্থিতি
চট্টগ্রামের বেশ কিছু এলাকা এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে মৌলভীবাজারে প্রধান নদীগুলোর পানি কমলেও কিছু এলাকা এখনও প্লাবিত। এছাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জের কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
সরকারি সহায়তা ও উদ্ধারকাজ
সরকারি হিসাবে, ১১টি জেলায় প্রায় ৮ লাখ ৮৭ হাজার পরিবার বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার এসব অঞ্চলে ৩ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা, ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল, এবং শুকনা খাবার বরাদ্দ করেছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশের সদস্যরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছেন।
এই বন্যা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি না হলে আরও বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যা দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই, সরকারের পাশাপাশি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য।
আরও পড়ুন: এতো ভয়ংকর বন্যা আগে কেউ দেখেনি