অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন, যা শনিবার বিকেল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত চলে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে মূলত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সংস্কার এবং আসন্ন নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে দলগুলোর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক সংস্কারের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়।
বৈঠকের মূল আলোচ্যসূচি
বৈঠকের আলোচ্যসূচির কেন্দ্রবিন্দু ছিল নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক সংস্কার, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু করার জন্য প্রস্তাবনা প্রদান। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনর্বহালের প্রস্তাব তুলে ধরেন এবং নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানান।
অনেক দল সংবিধানের সংস্কার, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কথা বলেছেন। কিছু দল সংসদীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রস্তাবও রেখেছে যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা যায় এবং একক ব্যক্তির ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া থেকে বিরত থাকা যায়।
অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ এবং তাদের প্রস্তাবনা
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, এবং বিভিন্ন ইসলামী দল। বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর পক্ষ থেকে উত্থাপিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাগুলো হলো:
- ইসলামী দলগুলোর প্রস্তাবনা: সাতটি ইসলামী দল যেমন হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এবং নেজামে ইসলাম পার্টি বিভিন্ন সংস্কারমূলক প্রস্তাব দিয়েছে। তারা সংবিধানে আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের ধারাটি পুনর্বহাল এবং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব রাখে। এছাড়া, তারা হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার এবং বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে নতুন তদন্তের দাবি জানায়।
- লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি): এলডিপি দলের নেতৃত্বে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, শিক্ষা ও প্রশাসনের পরিবর্তন, এবং দলীয় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রস্তাব দেন। তারা বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তনের দাবিও জানান।
- জাতীয় পার্টি: জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে বলা হয় যে, প্রশাসনিক সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। তারা প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার প্রস্তাবও দেয় এবং জাতীয় সংসদে অধিক প্রতিনিধিত্বের জন্য নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তনের প্রস্তাব করে।
- গণফোরাম: গণফোরাম দলের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন বলেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া, তারা সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে মত দেয় এবং সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পীর চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ১৩ দফা প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করে নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরির কথা বলা হয়। এছাড়া, তারা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দেয়।
বৈঠকের প্রধান ফলাফল
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন দলের মতামত গ্রহণ করছেন এবং এসব মতামতের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত রূপরেখা প্রস্তুত করা হবে। আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো একটি সমঝোতার পথে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে, যেখানে নির্বাচনের আগে এবং পরে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, আমরা আশা করি, একটি সার্বিক এবং সমন্বিত সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে, যার মধ্যে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠন থাকবে। দলগুলোও তাদের স্বতন্ত্র মতামত ও দাবিসমূহ তুলে ধরেছে যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পরিশেষে বলা যায়, এই আলোচনা এবং বৈঠকগুলোতে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলই একটি অভিন্ন সুরে কথা বলেছে যে, নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত। তারা দ্রুত নির্বাচনের আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে এবং একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সকলের মতামতের ভিত্তিতে একটি কার্যকর রূপরেখা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের চেষ্টা করছে। এই বৈঠকগুলোর মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক এবং সমন্বিত নির্বাচনী ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যা দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
আরও পড়ুন: বিমানবন্দরে মাহিয়া মাহিকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ: যা বললেন অভিনেত্রী