মাত্র ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ তরুণদের লাশ পুলিশের ভ্যানে স্তূপ করা হচ্ছে। এমনকি সেই লাশের স্তূপে থাকা অনেকের দেহ তখনও জীবিত ছিল। এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই ভিডিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে, যা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি তাদের ভয়ঙ্কর মনোভাবের পরিচায়ক।
প্রথমে ভিডিওটি কোথায় ধারণ করা হয়েছে, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়া যায়, এটি আশুলিয়া থানা এলাকার একটি ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে ৫ আগস্ট, যেখানে ছাত্র-জনতার একটি বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
ঘটনার পটভূমি
ঘটনার দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর একটি বিজয় মিছিল বের হয় বাইপাইল এলাকায়। মিছিলটি শেষ হওয়ার পর উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করে। পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে থানায় আশ্রয় নেয় এবং থানার গেট বন্ধ করে দেয়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে উত্তেজিত জনতা থানা ভবন ঘিরে ফেলে এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে হুঁশিয়ারি দেয় এবং পরে সরাসরি গুলি চালায়।
পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনা
ভিডিওতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীদের মরদেহ আশুলিয়া বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। পুলিশ সেগুলো একত্রিত করে একটি ভ্যানে স্তূপ করে রাখে। পরে ওই লাশগুলো থানার সামনে এনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই দৃশ্য অত্যন্ত মর্মান্তিক ছিল এবং অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখের সামনে এটি ঘটে।
ভিডিওর বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
ভিডিও প্রকাশের পর থেকেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। বিভিন্ন পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা যায়, আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ এফ এম সায়েদসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য সেই দিন গুলি চালনায় সরাসরি অংশ নেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, পুলিশের গুলিতে ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু ঘটে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘটনার বিচার এবং দায়ীদের শাস্তির দাবি ওঠে। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই আমরা ছাড় দিবো না। বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
পরিশেষে বলা যায়, এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সজাগ থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক সমাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, কিন্তু এই ঘটনা তাদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা এবং বর্বরতার চূড়ান্ত উদাহরণ। আমরা আশা করি, এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত হবে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।
এটা শুধু একটি ভিডিও নয়, এটি একটি জাতির বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়া একটি ঘটনার স্মারক। এই ধরনের বর্বরতা প্রতিহত করতে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন: ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় হত্যার হুমকি পেয়েছেন বাঁধন