গত এক মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। গণআন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামল শেষ হয়, এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয়। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন এনেছে, যা দেশের রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থার ব্যাপক সংস্কার করেছে। এই আর্টিকেলে আমরা এই পরিবর্তনগুলোর বিশদ আলোচনা করব।
১. পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার এবং পুনর্বাসন
শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানায় নজিরবিহীন হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশের উপর সহিংসতা, এবং কর্মবিরতির কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। এই অবস্থায় নতুন সরকারের প্রধান উদ্যোগ ছিল পুলিশকে পুনর্বাসন করা এবং জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা। বাহিনীর পোশাক ও লোগো পরিবর্তন করে তাদের মনোবল বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও এই পরিবর্তন কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবু সরকারের লক্ষ্য ছিল জনমানুষের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার।
২. প্রশাসনিক রদবদল
গত এক মাসে দেশের প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল ঘটেছে। বিশেষত স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, এবং স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন নিয়োগ ও বদলির মাধ্যমে কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের সরিয়ে নতুন মুখ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যারা আগের সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বদলে প্রশাসনে জায়গা দেওয়া হয়েছে আগের বঞ্চিত বা কোণঠাসা কর্মকর্তাদের।
৩. ব্যাংক খাত এবং আর্থিক সংস্কার
নতুন সরকার ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে জালিয়াতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা হয়েছে। সরকার দেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি দমনে শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকসহ দেশের বেশ কয়েকটি বড় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে।
৪. মামলা ও গ্রেফতার অভিযান
শেখ হাসিনার পতনের পর পরই তার এবং তার দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিশেষ করে, দুর্নীতি, হত্যা, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনা সহ অনেক শীর্ষ নেতাকে মামলার আসামি করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অন্যদিকে, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিভিন্ন মামলার সাজা বাতিল করা হয়েছে।
৫. রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতাকর্মীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যাদের আগের সরকারের সময় গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে জঙ্গিবাদ মামলার আসামিরা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, যা নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এছাড়া, শেখ হাসিনার আমলে গ্রেফতার হওয়া বহু শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক কর্মীকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
৬. গুমের ঘটনা এবং তদন্ত কমিশন
শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য নতুন সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। বিভিন্ন সময় গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই ফিরে এসেছেন এবং তাদের বর্ণনা অনুযায়ী ‘আয়না ঘর’ নামে একটি গোপন বন্দিশালার কথাও উঠে এসেছে। নতুন সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে।
৭. প্রশাসনিক পদত্যাগের হিড়িক
শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি, এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষপদে ব্যাপক পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের মুখে শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্যরা পদত্যাগ করেছেন। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও পদত্যাগ করেছেন।
৮. শিক্ষাখাতে সংস্কার
শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী শিক্ষাখাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে নতুন সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষপদে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং বাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দ্রুত নতুন উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
৯. গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন
শেখ হাসিনার পতনের পর গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। বাংলাদেশ প্রেসক্লাব এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের শীর্ষপদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরও সুসংহত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১০. দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
নতুন সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে পরিবর্তনগুলো দেখা যাচ্ছে, তা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে। শেখ হাসিনার আমলের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেওয়া এই পদক্ষেপগুলো দেশের সুশাসন ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, যেমন জঙ্গিবাদ মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে গত এক মাসে ঘটে যাওয়া বড় পরিবর্তনগুলো দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, এবং সামাজিক কাঠামোতে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলেছে। নতুন সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেশের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে আরও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। সময়ই বলে দেবে, এই পরিবর্তনগুলো দেশের সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার সহায়ক হবে কিনা।
আরও পড়ুন: তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা: ড. ইউনূসের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা