সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলে আসছে। সম্প্রতি এই বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি আরও জোরালো হয়েছে। চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য এটা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ বয়সসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারি চাকরির সুযোগ আরও প্রসারিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর এবং অবসরের বয়স ৫৯ বছর নির্ধারিত। তবে বিভিন্ন মহল থেকে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনও চলছে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কেন বাড়ানো উচিত?
বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করার সময়সীমা অত্যন্ত সংকুচিত। শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বলেন, সেশনজট বা অন্যান্য কারণে তাদের শিক্ষা জীবন দেরিতে শেষ হয়। ফলে, তারা সরকারি চাকরিতে আবেদন করার আগেই বয়সসীমা অতিক্রম করে ফেলে। সুতরাং, চাকরির আবেদন করার বয়সসীমা ৩২ বছর করা হলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।
জাতীয় যুবনীতির উপর ভিত্তি করে দেখা যায় যে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা যুবক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ৩০ বছর বয়সে চাকরির আবেদন করতে না পারাটা অনেকের জন্য একটি বড় বাধা। দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন বেড়ে প্রায় ৭৩ বছরে দাঁড়িয়েছে, যা ১৯৯১ সালে ৫৭ বছর ছিল। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ৩০ বছর বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়। তবে বর্তমান বাস্তবতায় তা অনেক পুরানো ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স বৃদ্ধির পেছনের কারণ
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স ৫৯ বছর হলেও অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতে তা বাড়ানো উচিত। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, পরমাণু গবেষণা, মহাকাশ গবেষণার মতো খাতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মীদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো প্রয়োজন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিচারকদের ক্ষেত্রে অবসরের বয়সসীমা ইতিমধ্যেই বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণা বা প্রকল্পগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। আর তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যেহেতু দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তির প্রয়োজন হয়, তাই সেখানে প্রবেশ ও অবসরের বয়স সীমাবদ্ধ রাখাটা অপ্রয়োজনীয়।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স বাড়ানোর একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে সরকারের আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা বাবদ ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যদি তিন বছর অবসরের বয়স বাড়ানো হয়, তবে তা সরকারের উপর বিপুল আর্থিক চাপ ফেলবে।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ছাড়াও পেনশন ও অন্যান্য সুবিধাগুলোও সরকারি কোষাগারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া, নতুন চাকরিপ্রার্থীদের সংখ্যাও বেড়ে যাবে, যার ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও জটিল হতে পারে।
অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা ভিন্ন ভিন্ন। ভারতের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩২ বছর, এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি ৪২ বছর পর্যন্তও হতে পারে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালে এ সীমা ৪০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নেপালে নারী ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা আরও বাড়ানো হয়েছে। এমনকি, পাকিস্তানে ৩০ বছরের নিয়ম থাকলেও বিশেষ কোটায় ৩২ বছরের প্রার্থীরাও আবেদন করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বয়সসীমা বৃদ্ধির প্রভাব
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স বাড়ানোর বিষয়টি কেবল চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্যই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সরকারি সেবার মান উন্নত করার জন্যও প্রয়োজন। ৩০ বছর বয়সে চাকরির জন্য যোগ্য না হওয়া বা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার পরও চাকরির জন্য আবেদন করতে না পারাটা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। তাছাড়া, অবসরের বয়স ৬৫ বছরে উন্নীত হলে অভিজ্ঞ কর্মীরা আরও কিছু বছর দেশের সেবা দিতে পারবেন, যা জাতীয় উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাতে দেশের আর্থিক খরচ বেড়ে না যায়, আবার বেকার সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পাওয়া যায়। জনগণের সুশাসন নিশ্চিত করতে এই কমিশন সুপারিশ করবে।
চূড়ান্ত কথা
সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সরকারের উপর বিশাল প্রভাব ফেলবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার উন্নয়নসহ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তবে চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য এটি হবে একটি সুসংবাদ।