মোবাইল আসক্তি আসলে একটা নেশার মতো। নির্দিষ্ট সময়ে নেশা না করলে যেমন শরীরে ছটফট শুরু হয় তেমনি নির্দিষ্ট সময়ে হাতে মোবাইল না এলে বাচ্চাদের অস্থিরতা শুরু হয়। কিন্তু এই অস্থিরতা ভালো লক্ষণ নয়। যারা মোবাইলে আসক্ত তারা এটাকে ঠিক নেশা মনে করে। বস্তুত তারা ভালো কোন কিছুই শিখতে পারে না। আর যারা শিখে তাদের মধ্যে কখনো আসক্তি হয় না। তারা নির্দিষ্ট দরকারে ফোন হাতে নেয় এবং দরকার শেষ হলে ফোন রেখে দেয়।
মোবাইল আসক্তি থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখার জন্য অভিভাবকদের জন্য আমার পক্ষ থেকে কিছু পরামর্শ রয়েছে। আশা করি, পরামর্শগুলো আপনারা সাদরে গ্রহণ করবেন।
১. বাসায় যে মোবাইলটি রয়েছে সেটি লুকিয়ে রাখুন। প্রয়োজনে বের করুন এবং বাচ্চাদের হাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দিন। তারা যেন ইচ্ছে মতো ফোনটি ব্যবহার করতে না পারে।
২. বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দেয়ার সময় মোবাইলের ইন্টারনেট কানেকশন (ডেটা কানেকশন) অফ করে রাখুন।
৩. ফোনে নির্দিষ্ট কিছু গেম রাখতে পারেন। কিছু গেম বাচ্চাদের মস্তিষ্কের উপকারও করে থাকে বিশেষ করে পাজল জাতীয় গেমগুলো। তাই, বাচ্চারা যখন ফোন হাতে নিয়ে গেম খেলতে চাইবে তখন তাদের ওসব গেম বের করে দিন।
৪. আপনার বাচ্চা যদি নিজেই প্লে স্টোর থেকে গেম ডাউনলোড করতে পারে তাহলে প্রয়োজনে প্লে স্টোর ডিজাবল করে রাখুন। প্রয়োজন মতো চালু করে নিবেন।
৫. আপনার ফোনে সিকিউরিটি সম্পর্কিত যাবতীয় ফিচারগুলো অন করে নিন। বিশেষ করে, এডাল্ট কোন ওয়েবসাইটে তারা যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেটা খেয়াল করুন এবং প্যারেন্টেরাল কন্ট্রোলস সেটিংস এর মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করুন। বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপনি এই সেটিংস খুঁজে পাবেন। প্রয়োজনে পেইড ভার্সনের একটি অ্যান্টি ভাইরাস ব্যবহার করুন।
৬. আপনার ছেলেমেয়ে মোবাইল ফোনে কাদের সাথে চ্যাটিং করছে, কি চ্যাটিং করছে সেগুলো নজরে রাখুন। তাহলে খারাপ কিছু হওয়ার অনেক আগেই টের পাবেন।
৭. আপনার বাচ্চা যদি আপনার থেকে কিছুটা দূরত্বে কোথাও পড়াশোনা করে এবং সাথে মোবাইল ফোন রাখতে চায় তাহলে বাটন ফোনগুলো দিন। স্মার্ট ফোন না দেয়াই ভালো। কিন্তু দূর থেকে আপনি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাহলে দিয়ে রাখুন সমস্যা নেই। কারন, স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় জানা যায়।
৮. মোবাইল ফোনে প্রয়োজন ছাড়া কারও সাথে কথা বলতে দেবেন না। কথা বলতে চাইলেই না করবেন বিষয়টি এমন নয়। নজরে রাখবেন যে, কথাগুলো প্রয়োজনীয় নাকি নিছক অপ্রয়োজনীয়!
৯. নির্দিষ্ট বয়সের পূর্বে ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে দেবেন না। আমি মূলত একাউন্ট খোলার কথা বলেছি। অন্তত ৮ম শ্রেণী পাশের পূর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন একাউন্ট নয়। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অন্তত এসএসসি পাশের পরে একজন ছাত্র-ছাত্রীর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রয়োজনে একাউন্ট খোলা উচিত।
১০. সন্তানের হাতে থাকা মোবাইলটি গোপনে নিয়ে চেক করবেন। অযাচিত কোন কিছু পেলে আলাদাভাবে সন্তানকে সেসব বিষয়ে সতর্ক করুন। কোনভাবেই বুঝতে দেবেন না যে, তার মোবাইল ফোনে আপনি তথ্যগুলো পেয়েছেন। তাহলে সে তথ্যগুলো শেয়ার করার জন্য অন্য মাধ্যম ব্যবহার করবে।
১১. আপনার সন্তানকে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতে বারণ করবেন। রাতের দিকে সর্বোচ্চ যেন ১১.৩০ এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে আর ওদিকে ৫.৩০ এর মধ্যে যেন উঠে পড়ে। তাহলে শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। পড়াশোনাতেও মনোযোগী হবে।
১২. সন্তানের সাথে সব ব্যাপারে সবসময় কিচিরমিচির করবেন না, চেচামেচি করবেন না। আপনার সন্তান আপনাদের কাছে (অভিভাবক হিসেবে) একটি সুন্দর পরিবেশ সবসময়ই প্রত্যাশা করে। চেষ্টা করবেন সন্তানের সামনে কোন ঝগড়া-ঝাটি না করার।
১৩. সন্তানকে নির্দিষ্ট হাত খরচ দেবেন। চাইলেই টাকা দেবেন না। অভাব শেখাবেন। এটা এজন্যই যে, আপনার সন্তান যেন সব টাকা বৈধ পথেই খরচ করে।
১৪. সন্তানের পড়াশোনার ঘরটা আপনাদের ঘরের সাথেই রাখুন। তাহলে সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে অন্য কিছু করতে পারবে না। আপনারাও মাঝে মধ্যে গিয়ে খেয়াল রাখতে পারবেন।
১৫. সন্তানকে বাইরে খেলতে যেতে উৎসাহিত করবেন। তাহলে মোবাইল আসক্তি কমে যাবে। আর খেলাধুলা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, শুধু শাসন আর শাসন করলেই কিন্তু হবে না। অতিরিক্ত শাসন সন্তানের জন্য আবার অমঙ্গল ডেকে আনে। আপনি অতিরিক্ত শাসন করেন কিন্তু আপনার সন্তান যেন সেটা বুঝতে না পারে। তাহলে কোন সমস্যা নেই। আর পড়াশোনা ও ভালো ফলাফল নিয়ে তার কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা করবেন না। এসব বিষয় আপনার সন্তানকে ডিপ্রেশনে ফেলে দিতে পারে। সন্তানকে সবসময় সাহস দেবেন। সে পরীক্ষায় খারাপ করলেও আপনারা তার পাশে আছেন এমন কথা বলবেন। তাহলে ঐ সন্তান সাহস পাবে এবং পরীক্ষায় ভালো করার জন্য তার মনে উৎসাহ জন্ম নেবে।
আর মোবাইল ফোন সম্পর্কিত যেসব কথা বলেছি সেগুলো কোনটাই ফেলে দেয়ার মতো কথা নয়। তবে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করবেন না। এখনকার ছেলেমেয়েরা অল্পতেই বুঝে ফেলে আর অল্প বয়সেই অনেক কিছু বুঝে। তাই সব ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। সর্বোপরি, আপনি ও আপনার সন্তানের মঙ্গল কামনা করে শেষ করছি।