শুরুতেই বলি, এই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য হলো ছেলেরা কখন মানুষ হয়! গ্রামের বাড়িতে গেছি বেড়াতে। রাতের বেলা শুধু মুরগির বাচ্চার কিচিরমিচির শুনছি। একটু ডিস্টার্বই হচ্ছে। দোতলার বারান্দায় নাকি আম্মু মুরগির বাচ্চা এনে রেখেছেন।
জানতে চাইলাম, মুরগির খোপ রেখে এখানে এগুলো কেন রেখেছেন? আম্মু জানালেন যে, মুরগির বাচ্চা মায়ের সাথে যত বেশিদিন থাকে তত দেরিতে ডিম দেয়, আর মা থেকে আলাদা করে রাখলে দ্রুত ডিম দেওয়া শুরু করে।
চট করে আমার চিন্তাটা মুরগির বাচ্চা থেকে সরে আমাদের বর্তমান সমাজের আধুনিক প্রজন্মের ‘ছেলেবাবুদের’ দিকে সরে গেল, যারা বয়স পচিশ-ত্রিশে এসেও মানসিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারে না।
আমার বন্ধু শরিফ। ওরা দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি বৃটিশ। ওর বাবা গিয়েছিলেন ষাটের দশকে। ও ওর নিজের জীবনের দারুণ একটা ঘটনা শুনিয়েছিল আমাকে।
ওর বয়স যেদিন ষোলো বছর পূর্ণ হয়ে সতেরোতে পড়ল, সেদিন ওর বাবা ওকে ডেকে বললেন, এখন থেকে তুমি বৃটিশ আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন ও স্বনির্ভর পুরুষ।
এখন থেকে তোমার দায়িত্ব তোমাকেই বহন করতে হবে। তোমার লেখাপড়ার খরচা তোমাকেই যোগাতে হবে। আর আমার বাসায় থাকতে হলে বাসা ভাড়া, আর খেতে হলে খাবার খরচ দিতে হবে।
যেই কথা সেই কাজ। কোনো ছাড় নেই। শরিফ বাধ্য হয়ে একটা শপে পার্টটাইম কাজ জোগাড় করল। স্কুল শেষে সেখানে কাজ করত।
সেই টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া আর খাবার বিল দিত। লেখাপড়া তো সরকারি স্কুলে, তাই এক বাচা বাঁচল। বৃটিশ কালচারে এটা স্বাভাবিক হলেও বাঙালী হিসেবে বাবার এই আচরণ মেনে নিতে ওর বেশ কষ্ট হয়েছিল।
এই সময়টাতে বাবার প্রতি জমেছিল এক রাশ ঘৃণা আর অভিমান। এই ঘৃণা আর অভিমান কিভাবে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিল তা আমরা একটু পরে বলছি।
জীবনের এই প্রথম ধাক্কাই তাকে অনেকটা পরিপক্বতা এনে দিয়েছিল। ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করেছিল। এখন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে।
আমি শরিফকে আমার এই বিশ বছরের বন্ধুত্বের জীবনে অসংখ্য ভালো কাজের উদ্যোগ নিতে ও অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। অনেক অসহায় মানুষকে, পরিবারকে ও সাহায্য করেছে।
ঠিক এর বিপরীতে গেলে আমাদের সমাজে অসংখ্য মানুষ দেখতে পাবেন, যারা ত্রিশে এসেও বালকসুলভ জীবন কাটায়, পুরুষ হয় না।
কোনো দায়িত্ব নিতে সক্ষম নয়, কোনোকিছুতে স্থির নয়, কোনো লক্ষ্যপানে ধাবিত নয়, কোনো অর্জনের জন্য স্থির নয়।
আমাদের অধিকাংশ মানুষদের দেখবেন বলতে, ছেলেমেয়েদের জন্যই তারা খেটে মরে, বাড়িগাড়ি বানায়। জিজ্ঞেস করলে বলে, আমরা যে কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছি আমার ছেলেমেয়েরা যেন তার মধ্য দিয়ে না যায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এ ধরণের চিন্তার বাবা-মায়ের সন্তানরা খুবই অযোগ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়।
যে বাবা-মা তাদের জন্য খেটে মরেছে, তাদের জন্য কিছু করা তো দূরের কথা, তারা নিজেদের দায়িত্বই নিতে সক্ষম হয় না।
বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া সম্পদের উপর নির্ভরশীল হয়। সেটা ফুরিয়ে গেলে চরম মানবেতর জীবনযাপন করে।
আমাদের ভিতরে যারা একটু স্মার্ট এবং বাস্তবসম্মত চিন্তা করেন, তারা ভাবেন—ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িগাড়ি রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়, তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলাই আমাদের দায়িত্ব।
তারা দেখা যায় উন্নত লেখাপড়ার জন্য ছেলেমেয়ের পিছনে অঢেল টাকাপয়সা ব্যয় করেন, দুনিয়ার সকল ঝুটঝামেলা ও বাস্তবতা থেকে এমনভাবে দূরে রাখেন, ফলে তারা হয় ‘শিক্ষিত বলদ’।
সত্যিকারভাবে ছেলেদেরকে পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ খুব কম মানুষই গ্রহণ করতে পারেন। আর এর অবধারিত ফল হলো ব্যক্তি হিসেবে, পরিবার হিসেবে, সমাজ ও জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়া।
একটা মানুষ যদি পৃথিবীর জন্য পনেরো-ষোলো বছর থেকে অবদান রাখা শুরু করতে পারে, তাহলে তার অবদানের মাত্রা ও মান দুটোই অনেক বৃদ্ধি পায়।
পক্ষান্তরে কথিত মাস্টার্স শেষ করে কর্পোরেট স্লেইভ হতে হতে যে সময় ব্যয় হয়ে যায়, তাতে অবদান রাখার সময় যেমন হারিয়ে যায়, তেমনই অবদানের মানও আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে ওঠে না।
আমি ড্রাইভিং শিখেছিলাম ৩৩ বছর বয়সের দিকে। আমার এক বন্ধু তখন বলেছিল—তুমি এখন আর ফার্স্ট ক্লাস এফিশিয়েন্ট ড্রাইভার হতে পারবা না, তুমি হবা ‘আংকেল ড্রাইভার’। সামনের আরেকটা গাড়ির পেছনে পেছনে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালিয়ে তোমার জীবন যাবে।
আমি খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করলাম যে, কথা খুবই সত্য। আমার পাশ দিয়ে বহু গাড়ি কাটিয়ে চলে যায়, আর আমার কাছে সামনের গাড়ির পিছনে ধরে রাখাকেই নিরাপদ ও আরামদায়ক মনে হয়।
তাই দেরি করে দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারটা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীন করে তা-ই নয়, দায়িত্ববোধের মান ও দায়িত্ব পালনের যোগ্যতাও হ্রাস করে ফেলে।
বাবার প্রতি শরিফের ঘৃণা আর অভিমানের কথা মনে আছে? এবার বলি সেই ঘৃণা আর অভিমান কিভাবে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিল।
বিয়ের দু’বছর পর যখন একটা ব্যবসা দাড় করানোর জন্য ভালো অংকের একটা নগদ অর্থ দরকার হলো তখন সেই কঠোর বাবা তার হাতে পাউন্ডের একটা বান্ডিল দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা বাসা ভাড়া আর খাওয়ার খরচ হিসেবে দেওয়া তোমার সেই অর্থ।
এমন কোনো প্রয়োজনের সময় দেওয়ার জন্য জমা করে রেখেছিলাম’। জীবনে কোনো এক সময় যদিও বাবার প্রতি শরিফের ঘৃণা জন্মেছিল, কিন্তু এখন বাবার সেই কঠোরতাটুকুকে সে তার জীবনের অমুল্য সম্বল মনে করে এবং বাবাকে নিয়ে সে আজ সত্যিকারে গর্ব অনুভব করে।
সেই মুরগির গল্পে ফিরে আসুন। ফিরে আসুন ইসলামের বাতলানো সমাজ চিন্তায়। মুরগির বাচ্চা যেমন মায়ের ডানার তলে থাকলে ডিম দেবে না, তেমনি আপনার ছেলেকে যতদিন ডানার নিচে রাখবেন সে দায়িত্বশীল হবে না।
এটা সৃষ্টির প্রকৃতির মধ্যে দেওয়া স্রষ্টার অমোঘ নিয়ম। ইসলাম বলে একটা ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার তিনটা সাইন:
১. স্বপ্ন দোষ হওয়া
২. নাভির নিচে লোম গজানো, কিংবা
৩. বয়স পনেরো বছরে উপনীত হওয়া
এরপর ইসলামি আইনমতে সে একজন পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। তার উপর শরিয়তের সকল আইন কার্যকর। মহান আল্লাহ এই সীমাটা এইজন্যই নির্ধারণ করেছেন যে, এই বয়স থেকে সে জীবন ও জগতে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন শুরু করবে।
আমাদের উচিত ছিলো, আমাদের সন্তানদেরকে এই বয়সে উপনীত হওয়ার আগেই তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ও যোগ্য করে গড়ে তোলা; কিন্তু সেটা না করে একটা দীর্ঘ সময় তাদেরকে স্পুন ফিডিং করে আমরা একটি অকর্মন্য ও অযোগ্য প্রজন্ম গড়ে তুলছি।
উৎস: ফেইসবুক হতে নেওয়া