বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কথাটির সাথে আমরা নতুন পরিচিত হয়েছি। ছাত্র আন্দোলন পূর্বেও হয়েছে কিন্তু এতোটা বিস্তৃত আর এতোটা শক্তি নিয়ে হয়নি। এই আন্দোলন পৃথিবীকে যেন কাঁপিয়ে তুলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই আন্দোলন থেকে আমরা অনেকগুলো প্রাণ হারিয়েছি। এই আন্দোলন সফল করতে অনেক তরতাজা রক্ত দিতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা বিচ্যুত হয়েছে। দেশে নতুন সরকার এসেছে। যদিও এই সরকারকে বলা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ড. ইউনুস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। তাকে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ চিনে। তার মতো একজন সরকার আমাদের বোধ হয় সত্যিই প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু এখন কানাঘোষা শুনতেছি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পক্ষ হতে নতুন রাজনৈতিক দল আসবে। বিষয়টি আমার কাছে ঘোলাটে মনে হয়েছে। দল আসতে পারে কিন্তু সরাসরি রাজনৈতিক দল আসা উচিত হবে না। কেন না সে কথা বলছি বিস্তারিত।
যারা এখন সমন্বয়ক তারা তো সবসময় সব বয়সে ছাত্র থাকবে না। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো মাস্টার্স পাশ করে ফেলেছেন। সুতরাং তাদের জীবনে ছাত্র শব্দটি হয়তো আর কয়েক মাস থাকবে। তারপর আর তারা ছাত্র হিসেবে পরিচিত থাকবে না। সুতরাং একটা নতুন দল হলে তারা সেখানে রাজনীতি করবে এটা ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সমন্বয়ক হিসেবেও কিন্তু বছরের পর বছর থাকা সম্ভব।
নতুন রাজনৈতিক দল এলে এমন হতে পারে যে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে লক্ষ্য তা থেকে তারা বিচ্যুত হতে পারে। রাজনীতির মধ্যে বহু মতাদর্শ থাকে। দেখা যাবে, ছাত্ররা সবাই সেই মতের সাথে একমত নাও হতে পারে। প্রতিবছর নতুন ছাত্র স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিতে ভর্তি হবে আবার অনেকেই বের হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করবে এটা তো স্বাভাবিক। সুতরাং এখন যদি কোন দল হয় তাহলে সেটা একপাক্ষিক একটা গোষ্ঠীর জন্য হিতকর হবে, পুরো ছাত্র সমাজ তথা দেশের জন্য নাও হতে পারে।
আবার দেখুন, যে দুটো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশে মূলত রয়েছে (বিএনপি, আওয়ামী লীগ) তারাও কিন্তু হঠাৎ করে উদয় হয়নি। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের পরিবারের অনন্য ভূমিকা ছিল। তাই মানুষ তাদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দলকে মেনে নিয়েছে। এখন ছাত্ররা হাজারো প্রাণের বিনিময়ে যে নতুন স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে সেটা রক্ষা করতে গেলে তাদেরও একটা দল গঠন করা আসলে প্রয়োজন। কারন, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের রাজনীতি মানুষ আর তেমন চায় না। তবে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের যতোটা ঘৃণা তৈরী হয়েছে বিএনপির প্রতি সেটা হয়নি। কারন, তারা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলো না।
তবে আমি মনে করি, ছাত্রদের একটি রাজনৈতিক দল থাকা উচিত যারা এখন থেকেই দেশকে নেতৃত্ব দিবে অন্যদিকে বাংলাদেশের সকল ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সেই চেতনা থাকুক যে চেতনার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দেশকে আবার স্বাধীন করেছে। তাহলে আজকের ছাত্ররা ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদ হয়ে যদি আওয়ামী লীগের মতো আচরণ করে তাহলে তখনও যেন চলমান ছাত্রছাত্রীরা তাদের কাছ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। ছাত্ররা দল করুক বা না করুক তাতে আমার তেমন আপত্তি নেই কিন্তু তাদের যে একতা সেটা যেন কখনো নষ্ট না হয়।
রাজনীতি আর ছাত্রছাত্রীদের একতা দুটো ভিন্ন জিনিস। রাজনীতিতে অনেক স্বার্থপরতা তৈরী হয় কিন্তু ছাত্র-জনতার একতার মধ্যে সেটা নেই। ছাত্র-জনতা চায় এক মুঠো ভাত খেতে, দ্রব্যমূল্য যেন সহনীয় দামে কিনতে পারে, দেশে যেন নিরাপত্তা থাকে, কোথাও যেন ঘুষ-দুর্নীতি না হয় ইত্যাদি। তাদের একক কোন চাওয়ার নেই। শান্তিতে খেয়ে যাতে একটু নিরাপদে ঘুমাতে পারে মানুষের এটাই চাওয়া।
আর রাজনীতি হলো একটি একক গোষ্ঠী। সেখানে কয়েকজন এমপি থাকবে, কয়েকজন মন্ত্রী থাকবে এবং সরকার প্রধান থাকবে। ছাত্র-জনতার যেকোন চাওয়া একটি রাজনৈতিক দল কখনোই পূর্ণভাবে হয়তো পূরণ করতে পারবে না। কারন, সেখানে ব্যক্তি স্বার্থ থাকতেই পারে। একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে একজন রাজনৈতিক কর্মী কখনোই যেতে পারে না।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, দেশে বার বার ছাত্র-জনতার ঐক্যের শক্তি প্রয়োজন হতে পারে। আবার দেশ পরিচালনা করতে রাজনৈতিক দলও প্রয়োজন। সুতরাং রাজনৈতিক দল ছাত্ররা গঠন করলে তাতে কারও দ্বিমত থাকবে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু কথা হচ্ছে, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক বা আসুক না কেন – তারা যদি জনগণের সরকার না হয় তাহলে ছাত্র-জনতা তাদের ঐক্যের শক্তি দিয়ে তাদের যেন পরাজিত করে।
আরও পড়ুন: জুলাই ২০২৪ – এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার নাম