ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল। এক রাতে সেখানে খাবারের জন্য গিয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সী তোফাজ্জল হোসেন, যার জীবন তখনই শেষের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু তিনি তা জানতেন না। তোফাজ্জল, যিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন, ক্ষুধার জ্বালা মেটানোর আশায় হলে ঢুকেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাঁকে চোর সন্দেহে ধরা হয় এবং ভয়াবহভাবে নির্যাতন করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুতে রূপ নেয়।
নির্যাতনের ভয়াবহতা: হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী তাঁকে ধরে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এরপর শুরু হয় ধাপে ধাপে নির্যাতন। তাঁকে স্ট্যাম্প, রড, এবং লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। এমনকি তাঁর গোপনাঙ্গে জোরে আঘাত করা হয়, যা তাঁর শারীরিক অবস্থাকে আরও করুণ করে তোলে। তোফাজ্জলের শরীর থেকে মাংস খসে পড়তে শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাঁকে তিন দফায় মারধর করা হয়—প্রথমে হালকা মারধর করা হয় গেস্ট রুমে, তারপর ক্যান্টিনে নিয়ে খাওয়ানো হয়। কিন্তু এর পরের নির্যাতন ছিল আরও নৃশংস।
গেস্ট রুমে নৃশংস নির্যাতন: তাঁকে দ্বিতীয়বার নিয়ে যাওয়া হয় এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্ট রুমে, যেখানে প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। সেখানে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালায়। তাঁকে হাত বেঁধে পেটানো হয়, চোখ বেঁধে মারধর করা হয়। মারতে মারতে তোফাজ্জল পড়ে গেলে, তাঁকে পানি খাওয়ানো হয় এবং তখন তাঁকে আবারও পেটানো শুরু হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী তোফাজ্জলের পায়ে গ্যাস লাইট দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আরেকজন তাঁর ভ্রু এবং চুল কেটে দেয়।
মানসিক অসুস্থতা উপেক্ষা: নির্যাতনের মধ্যেই তোফাজ্জল চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বলেন, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। কয়েকটি ফোন নম্বর দেন, যেখানে ফোন করে জানা যায়, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা বিশ্বাস করতে চায়নি। তাঁকে নির্যাতন করতে থাকে, এমনকি শিক্ষকদের সামনেও। শিক্ষকদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তাঁকে একের পর এক আঘাত করতে থাকে, যা তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
মর্মান্তিক মৃত্যুর পথে যাত্রা: তোফাজ্জলের শরীর এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, তাঁর পায়ের মাংস খসে পড়ে। তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁর গোপনাঙ্গে লাঠির আঘাত এতটাই নৃশংস ছিল যে, তাঁর শরীর সম্পূর্ণরূপে দুর্বল হয়ে পড়ে। তখনও কিছু শিক্ষার্থী তাঁকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। তাঁকে আরও মারধর করা হয়, বিশেষ করে তাঁর আঙুলগুলো পায়ের বুট দিয়ে মাড়িয়ে দেওয়া হয়। তোফাজ্জলকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়, কারণ তাঁর শরীর অসহনীয় নির্যাতনে ভেঙে পড়ে।
পরিবারের বেদনাদায়ক বাস্তবতা: তোফাজ্জলের মা-বাবা এবং ভাই কেউ জীবিত নেই। তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছিল সড়ক দুর্ঘটনায়, আর মায়ের মৃত্যু হয় লিভার ক্যান্সারে। তোফাজ্জলের মানসিক অসুস্থতা শুরু হয় পরিবারের এই অপূরণীয় ক্ষতির পর থেকে। তাঁর একমাত্র ভাই, যিনি পুলিশের এসআই ছিলেন, তিনিও ক্যান্সারে মারা যান। ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে তোফাজ্জল একেবারে ভেঙে পড়েন এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ক্ষুধার জ্বালায় ঘুরে বেড়ানো তোফাজ্জল সেই হলের শিক্ষার্থীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন।
গ্রামের শোক এবং প্রতিক্রিয়া: তোফাজ্জলের এই নির্মম মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে, তাঁর গ্রামের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে নেমে আসে শোকের ছায়া। এলাকার মানুষ বিষণ্ণতায় ডুবে যায়। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান আল ইমরান তোফাজ্জলকে নিয়ে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন যে, তোফাজ্জল ছিলেন একজন সহৃদয় এবং পরোপকারী ছাত্রনেতা। মানসিক ভারসাম্য হারানোর পরও তাঁকে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। বরং নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
বিচারের দাবি: তোফাজ্জলের চাচা ফজলুল হকও নির্মমভাবে হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন। আইন প্রতিষ্ঠা করে এ ঘটনার বিচার করার জন্য সকলের মধ্যে দাবি উঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন ঘটনায় সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। তোফাজ্জলের মৃত্যু যেন এক মানবতার করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যেখানে একজন অসহায় মানসিক রোগীও নিরাপদ নয়।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্র রাজনীতির নৈতিক অবক্ষয়ের ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের এমন ভয়াবহ কর্মকাণ্ড দেশের মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়েছে।
আরও পড়ুন: সেনাবাহিনী ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতায় যা যা করতে পারবেন