ইউটিউব হলো একটি অনলাইন ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম যেখানে ব্যবহারকারীরা ভিডিও আপলোড করতে, দেখতে, শেয়ার করতে, মন্তব্য করতে এবং লাইক দিতে পারেন। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইউটিউব আজকের দিনে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। এখানে বিভিন্ন ধরণের ভিডিও কন্টেন্ট পাওয়া যায়—বিনোদন, শিক্ষা, সংবাদ, টিউটোরিয়াল, মিউজিক ভিডিও, লাইভ স্ট্রিমিং, এবং আরও অনেক কিছু।
বিশ্বের প্রায় সব দেশে ইউটিউব ব্যবহার করা হয় এবং এর বিভিন্ন ভাষায় ভিডিও উপলব্ধ। প্ল্যাটফর্মটি বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উপলব্ধ, তবে ইউটিউব প্রিমিয়াম নামে একটি সাবস্ক্রিপশন সার্ভিসও রয়েছে যা বিজ্ঞাপনমুক্ত দেখার অভিজ্ঞতা, অফলাইন ডাউনলোড, এবং ইউটিউব মিউজিক প্রিমিয়ামের মতো সুবিধা প্রদান করে।
ইউটিউবের প্রতিষ্ঠাতা ও ইতিহাস
ইউটিউবের প্রতিষ্ঠাতা তিনজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা—চ্যাড হার্লি, স্টিভ চেন, এবং জাওয়েদ করিম। তারা তিনজনই পেওপাল কোম্পানির সাবেক কর্মচারী ছিলেন এবং একটি সহজ ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম তৈরির লক্ষ্যে ইউটিউবের সূচনা করেন। ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউটিউবের ডোমেইন নাম নিবন্ধিত করা হয়, এবং একই বছরের এপ্রিলে প্ল্যাটফর্মটির বেটা সংস্করণ চালু হয়।
ইউটিউবের প্রথম ভিডিওটি ছিল ‘Me at the zoo’, যা জাওয়েদ করিম আপলোড করেছিলেন। ভিডিওটি ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল পোস্ট করা হয় এবং এটি এখনও ইউটিউবে দেখা যায়। ইউটিউবের সহজ ইন্টারফেস এবং ব্যবহারকারীদের জন্য ভিডিও আপলোডের সুবিধা থাকায় এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে গুগল ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে ইউটিউবকে কিনে নেয় এবং এর পর থেকে এটি আরও বেশি উন্নত ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।
ইউটিউব থেকে আয় করার উপায়
ইউটিউব থেকে আয় করা সম্ভব হলে অনেকেই এটি পেশা হিসেবে নিতে আগ্রহী হন। ইউটিউব থেকে আয়ের বিভিন্ন উপায় রয়েছে, যা নিচে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হলো:
- গুগল অ্যাডসেন্স (মনিটাইজেশন): ইউটিউব পার্টনার প্রোগ্রামে যোগদান করলে ভিডিওগুলিতে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এই বিজ্ঞাপনগুলো থেকে আয় হয় ক্লিক এবং ভিউয়ের ভিত্তিতে। ইউটিউবারদের ভিডিওতে কতবার বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে এবং বিজ্ঞাপনগুলির প্রকারভেদ অনুযায়ী আয়ের পরিমাণ নির্ধারিত হয়।
- স্পনসরশিপ এবং পেইড প্রোমোশন: বিভিন্ন কোম্পানি এবং ব্র্যান্ডগুলো ইউটিউবারদের সাথে তাদের পণ্য বা সেবার প্রচারের জন্য চুক্তি করে থাকে। এটি হতে পারে ভিডিওর মধ্যে স্পন্সরড কন্টেন্ট, পণ্য পর্যালোচনা, অথবা ব্র্যান্ড সহযোগিতার মাধ্যমে।
- অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং: ইউটিউবাররা বিভিন্ন প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের অ্যাফিলিয়েট লিংক তাদের ভিডিওর বিবরণে শেয়ার করেন। যখন দর্শকরা এই লিংকগুলোর মাধ্যমে কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন ইউটিউবাররা কমিশন পান।
- মার্চেন্ডাইজিং: জনপ্রিয় ইউটিউবাররা তাদের নিজস্ব পণ্য যেমন টি-শার্ট, ক্যাপ, মগ, এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে আয় করতে পারেন। ইউটিউবের “মার্চ শেলফ” ফিচারটি তাদের চ্যানেলের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির সুবিধা প্রদান করে।
- সুপার চ্যাট এবং সুপার স্টিকার: লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সময় দর্শকরা সুপার চ্যাট বা সুপার স্টিকার কিনে ইউটিউবারদেরকে সরাসরি অর্থ প্রদান করতে পারেন। এটি ইউটিউবারদের জন্য একটি অতিরিক্ত আয়ের উৎস হতে পারে।
- চ্যানেল মেম্বারশিপ: ইউটিউব চ্যানেলগুলি সদস্যপদ বিক্রির মাধ্যমে নিয়মিত আয় করতে পারে। দর্শকরা মাসিক সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে চ্যানেলের সদস্য হতে পারেন এবং এতে তারা এক্সক্লুসিভ কন্টেন্ট, ইমোজি, ব্যাজ এবং অন্যান্য সুবিধা পেতে পারেন।
ইউটিউব থেকে কেমন আয় হতে পারে?
ইউটিউব থেকে আয়ের পরিমাণ নির্ভর করে বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর, যেমন ভিডিও ভিউ সংখ্যা, ভিউয়ারের জিওগ্রাফিকাল লোকেশন, চ্যানেলের বিষয়বস্তু, এবং বিজ্ঞাপনের প্রকার। সাধারণত, প্রতি ১,০০০ ভিউতে ইউটিউবাররা ১ থেকে ৫ ডলার আয় করতে পারেন, তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি বা কম হতে পারে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু এবং দর্শকদের উপর নির্ভর করে।
বড় বড় চ্যানেলগুলো যেমন—যাদের মিলিয়ন বা তার বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে—তাদের মাসিক আয় কয়েক হাজার ডলার থেকে শুরু করে লক্ষ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মিস্টার বিস্ট বা পিউডিপাইয়ের মতো ইউটিউবারদের বার্ষিক আয় লক্ষাধিক ডলার।
বিশ্বের সেরা কয়েকজন ইউটিউবার
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইউটিউবারদের মধ্যে আছেন:
- পিউডিপাই (ফেলিক্স কজেলবার্গ): সুইডিশ গেমার ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, যিনি ১১ কোটিরও বেশি সাবস্ক্রাইবার নিয়ে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ইউটিউবার। তিনি মূলত ভিডিও গেম প্লে-থ্রু এবং কৌতুক কন্টেন্টের জন্য পরিচিত।
- মিস্টার বিস্ট (জিমি ডোনাল্ডসন): তার উদ্ভাবনী চ্যালেঞ্জ ভিডিও এবং দানশীলতার জন্য পরিচিত, যা তাকে দ্রুত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তার বার্ষিক আয় লক্ষাধিক ডলার এবং তার চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়েছে।
- নাস্তিয়া: শিশুদের বিনোদনমূলক ও শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরির জন্য পরিচিত, নাস্তিয়ার চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। তার আয়ও বার্ষিক কয়েক মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
- রায়ানস ওয়ার্ল্ড: একটি শিশু ইউটিউবার যার চ্যানেলটি খেলনা পর্যালোচনা এবং শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কন্টেন্টের উপর ভিত্তি করে তৈরি। তার আয় বছরে ২০-৩০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে।
বাংলাদেশের সেরা কয়েকজন ইউটিউবার
বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় ইউটিউবার আছেন যারা তাদের সৃজনশীলতা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করেছেন:
- তন্ময় আহমেদ: মূলত কৌতুক ভিডিও এবং সামাজিক বিষয়ভিত্তিক কন্টেন্টের জন্য পরিচিত। তার ভিডিওগুলো সাধারণত হালকা মেজাজের এবং বিনোদনমূলক।
- সালমান মুক্তাদির: বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের ইউটিউবারদের একজন, যিনি মূলত মজার ভিডিও এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কন্টেন্ট তৈরি করেন।
- শরিফুল ইসলাম: শিক্ষামূলক ভিডিওর জন্য পরিচিত, যেখানে তিনি প্রোগ্রামিং, প্রযুক্তি এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন।
- হাসিবুল হাসান: তার চ্যানেলে বিভিন্ন ধরণের ভ্লগ, চ্যালেঞ্জ ভিডিও এবং ট্রাভেল কন্টেন্ট পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায়, ইউটিউব বর্তমানে কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী ক্যারিয়ার প্ল্যাটফর্ম যেখানে মানুষ তাদের সৃজনশীলতা এবং দক্ষতা প্রদর্শন করে আয় করতে পারেন। যারা ইউটিউবে সফল হতে চান তাদের জন্য প্রয়োজন কৌশলগত কন্টেন্ট পরিকল্পনা, ধারাবাহিকতা, এবং দর্শকদের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা। ইউটিউবের জগতে প্রবেশ করার জন্য সৃজনশীলতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতার পথে এগিয়ে যান।
আরও পড়ুন: অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে বিস্তারিত | ভালো-মন্দ তফাৎ